শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

পথশিশুরা আর কতদিন পথে থাকবে

আজহার মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ৩০ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

শিশু শব্দটার সাথে মিশে আছে ভালোবাসা, আদর এবং মমতা। কিন্তু শিশুদের যখন পথশিশু, টোকাই, রাস্তার ছেলে ইত্যাদি নামে ডাকা হয় তখন বুকে লাগে। কেন একটা শিশুকে পথশিশু বলবো? সে রাস্তায় থাকে এজন্য? তাহলে আবার প্রশ্ন করছি, কেন একটা শিশু রাস্তায় থাকবে? জানি এর কোনো গ্রহণযোগ্য উত্তর নেই। এরপরও আমাদের দেশে পথশিশুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আসলে এর মূলে রয়েছে অজ্ঞতা, দারিদ্রতা, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব। একশ্রেণির অশিক্ষিত ও দরিদ্র মানুষ অপরিকল্পিতভাবে সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর তাদেরকে পরিত্যাগ করে। এভাবেই বাড়তে থাকে অবহেলিত পথশিশুর সংখ্যা। এসব পিতামাতা সন্তানদের মারধর করে রোজগার করার জন্য। তখন থেকেই শুরু হয় তাদের অবহেলিত কষ্টের জীবন। 

আসলে মানুষের মানবতা এবং মনুষ্যত্ব দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ফলাফলে পথশিশুর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে আমাদের বিবেক কখনও কি নাড়া দেয় না? আজ যে ছোট ছোট বাচ্চা রাস্তায় পত্রিকা বিক্রি করে, ফুল বিক্রি করে কিংবা কিছু খাবে বলে টাকা চায় তাদের ভবিষ্যত কি? যে বয়সে তাদের হাতে থাকা উচিৎ বই-খাতা সে বয়সে তাদের হাতে প্লাস্টিকের বস্তা। রাস্তায় রাস্তায় তারা প্লাস্টিক খুঁজে। কি নির্মম বেদনাময় দৃশ্য!
২০১৫ সালের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ছিলো ১০ লাখ, যার মধ্যে আড়াই লাখের বেশিই ছিলো রাজধানীতে। বর্তমানে বাংলাদেশে পথ শিশুর সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। কেউ বলেন ২১ লাখ। আবার কেউ বলেন ২৪ লাখ। তবে এদের মধ্যে ৫০ হাজার শিশু আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায় থাকে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পথশিশুদের ৫১ ভাগ ‘অশ্লীল কথার শিকার’ হয়। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ২০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয় মেয়েশিশু। ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আর মেয়ে পথশিশুদের মধ্যে ৪৬ ভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার।
পথ শিশুদের নিয়ে কাজ করছে লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (লিডো) নামের একটি এনজিও। সংস্থাটির তথ্যমতে, পথশিশুদের কেউ কেউ মাদকাসক্ত হয়ে রাস্তায়ই মারা যায়। কেউ কেউ বিভিন্ন চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়ে যায়। যারা পাচারের শিকার হয়, তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি হয়। নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় তারা। যারা মেয়ে, তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কোনো কোনো গ্যাং তাদের যৌনকর্মী হতে বাধ্য করে। এছাড়াও, অপরাধীচক্রগুলো এদের মাদকসহ নানা অবৈধ ব্যবসায় কাজে লাগায়। এরা আসলে অপরাধী নয়। এরা অপরাধের শিকার হয়। রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের নানা কাজে ব্যবহার করে।
সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ) নামের একটি সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু গোসল করতে পারে না, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই এবং ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলে ডাক্তারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারে না। একই গবেষণায় বলা হয়, ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে সর্বোচ্চ ছয় মাস থাকে। এদের মধ্যে ২৯ শতাংশ শিশু স্থান পরিবর্তন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কারণে আর ৩৩ শতাংশ পাহারাদারের কারণে। খোলা আকাশের নীচে ঘুমানোর পরও তাদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ শিশুকে মাসিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা মাস্তানদের দিতে হয়। তারা পুলিশি নির্যাতন এবং গ্রেপ্তারেরও শিকার হয়। জানা যায়, পথশিশুদের বড় একটি অংশ আসে দরিদ্র পরিবার থেকে। দারিদ্র্যই মূল কারণ। বাবা-মায়ের বহু বিবাহও একটি কারণ। তার সাথে যুক্ত হয় নদী ভাঙন, ভূমিহীনতা, জলবায়ুর পরিবর্তন।
আমরা যদি একটু সুস্থ মস্তিষ্কে ভেবে দেখি, আসলে এই পথশিশুদের জীবন যাপন অনেক জটিল। নিজেদের চেয়ে অনেক বেশি বয়সের লোকজনের সাথে থাকতে হয় এদের। ভিক্ষাবৃত্তিও করতে হয়। আর ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ থেকে তারা নানা জিনিস সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য। তারা নানা রোগে আক্রান্ত হয়। পথশিশুদের ২৫-৩০ ভাগ মেয়ে। তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
সা¤প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে যে, পথশিশুদের ৮২ শতাংশই নানা ধরনের পেটের অসুখে আক্রান্ত। এই অসুখের পেছনে যে অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ দায়ী, তা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি নোংরা পরিবেশে থাকার কারণে এদের মধ্যে চর্মরোগের হারও অনেক বেশি, চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় । ভাসমান এই শিশুদের ৬১ শতাংশই কোনো না কোনো চর্মরোগে আক্রান্ত। পথশিশুদের মধ্যে নানা ধরনের সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার হারও তুলনামূলক বেশি।
ঢাকাসহ সারাদেশে পথশিশুদের নিয়ে অনেক বেসরকারি সংগঠন কাজ করে। কেউ খাবার দেয়। কেউ পোশাক দেয়। কেউ দেয় শিক্ষা। কেউ আবার তাদের বিনোদনের ব্যবস্থাও করে। তবে দিনশেষে তাদের পথেই ফিরে যেতে হয়। তাদের পুরোপুরি পুনর্বাসনের জন্য খুব বেশি উদ্যোগ নেই। শহরে অনেক বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ আছে এই পথশিশুদের জন্য। সরকারি কিছু উদ্যোগও আছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগই টেকসই নয়। এটা ঘায়ে মলম দেয়ার মতো। আসলে তাদের দরকার স্থায়ী পুনর্বাসন। ফ্যামিলি অ্যাটাচমেন্ট। সেটা কিভাবে করা যায় তা সরকারকে ভাবতে হবে। তাদের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনাই হলো আসল কাজ। তাদের শিক্ষা, থাকার স্থায়ী জায়গা এবং খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। তারা যদি যেখানে আছে, সেখানেই থাকে, তাহলে কোনো লাভ নেই। কারণ পথ থেকে তাদের ঘরে তুলতে হবে। তারা এখন পথকেই তাদের ঘর বানিয়ে ফেলছে। কিন্তু আমাদের যে বিষয়টি সবচাইতে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, সেটা হচ্ছে থাকার ব্যবস্থা। এসব বাচ্চারা যদি কোনো গাইড লাইনের ভেতর দিয়ে না যায় তবে তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত অন্ধকারে। এখন দেখাযায় পরিবারের সাথে থেকেও ছেলে-মেয়েরা বিপথে চলে যায়। সেখানে রাস্তায় থাকা এসব ছেলে-মেয়েদের বিপথে নিয়ে যাওয়া কোনো ব্যপার বলে আমার মনে হয় না। তাই তাদের সরকারের সহয়তায় হোক আর বেসরকারি সহয়তায় হোক থাকা-খাওয়া এবং পড়াশুনার মাধ্যমে অন্যান্য বাচ্চাদের মতো জীবন-যাপন করার সুযোগ করে দিতে হবে। তবেই পথশিশু নামক কোনো নাম শিশুর সাথে যুক্ত হবে না। দেশ থেকে মুছে যাবে টোকাই নামক শব্দটি। শিশু থাকবে শিশুর মতোই। কিন্তু পথশিশুর ঠিকানা যদি পথই রয়ে যায় তবে এসব শিশুর জন্য লোক দেখানো ভালোবাসায় কিছুই হবে না। আপনি একশটা শিশুকে লোক দেখানো সেবা না দিয়ে একটা শিশুর দায়িত্ব নিন। যেন সেই শিশুটা বড় হয়ে ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার হয়ে উঠে। এভাবে প্রতিটা সংগঠন যদি পথশিশুদের সাময়িক সেবা এবং খাবার না দিয়ে তাদের পুরো দায়িত্ব নেয়, তাহলে অন্তত কিছু শিশুও দেশের সম্পদে রূপান্তরিত হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, আমরা চাইলেই সব পারি। কিন্তু আমরা সেভাবে চিন্তা করি না। আমরা জন্মদিনে পথশিশুদের সাথে সময় কাটিয়ে মানুষকে ফেসবুকে দেখাই। কিন্তু কয়েকটা পথশিশুকে শিশুতে রুপাস্তর করি না। চাইলেই কিন্ত পারি। তাই আসুন, লোক দেখানো ভালোবাসা ছেড়ে এসব শিশুর ভবিষ্যত নিয়ে ভাবি।
লেখক: সাংবাদিক

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
** মজলুম জনতা ** ৩০ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:২৩ পিএম says : 0
যে বয়সে বই বগলে করে পাঠসালায় যাবার কথা।যে বয়সে নাটাই হাতে ঘুড্ডি উড়ানোর কথা।সেই বয়সে কমল হাতে শক্ত ইট-পাথর ভাংগ্ঙে কেন?কাদেঁ ঝোলা নিয়ে কাগজ পলিথিন হাড্ডি গুড্ডি কুড়ায় কেন? কে দেবে জবাব?কে নেবে এদের দ্বায়ীত্ব? সরকার কে ই দ্বায়ীত্ব নিতে হবে।।
Total Reply(0)
jack ali ১ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৪:১৫ পিএম says : 0
পথশিশুরা আর কতদিন পথে থাকবে? until and unless we run our country by the Law of our creator---- those who are in power.....their heart is harder than stone----how come those who are in power they enjoy every thing ----their life style is like a king ---- by our hard earned tax payers money-
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন