বুধবার, ২২ মে ২০২৪, ০৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সচেতনতাই এইডস থেকে আত্মরক্ষার উপায়

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০০ এএম | আপডেট : ৩:১২ এএম, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৯

পহেলা ডিসেম্বর প্রতি বছরই ‘বিশ্ব এইডস দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। এই দিনে বাংলাদেশের সরকারি স্বাস্থ্য দফতরসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন নানা কর্মসূচি নিয়ে থাকে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে। কারণ এইচআইভি/ এইডস এমন একটি রোগ, যার থেকে মুক্তির কোনো ঔষধ নেই। তবে সজাগতা এই মহামারি থেকে বাঁচার অন্যতম এবং সবচেয়ে সহজ হাতিয়ার।

HIV কী? HIVর পুরো নাম হচ্ছে: Human
Immuno deficioency virus.. এটা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে এবং শরীরে বিদ্যমান ইমিউন সিস্টেমকে নষ্ট করে দেয়। এইডস (AIDS) কী? এইডস (AIDS) মানে হচ্ছে: Acquired Immuno deficioency Syndrome. এটা হচ্ছে একজন এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তির শরীরে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে কমে গিয়ে একটা সময়ে শরীরে বিভিন্ন রোগের একটি অবস্থা। HIV এবং AIDS এর পার্থক্য কী? এইচআইভি হচ্ছে ভাইরাসটির নাম এবং এইডস হচ্ছে এই ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট একটি অবস্থা।
HIV এবং এর লক্ষণ কী কী? লক্ষণগুলো সাধারণত আমরা অনেকেই অবজ্ঞা করি। কারণ এই লক্ষণগুলো অন্যান্য কিছু রোগের কারণেও হতে পারে। তবে এগুলোকে অবজ্ঞা না-করে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াটাই শ্রেয়।
HIV এর প্রাথমিক লক্ষণ হচ্ছে: জ্বর, অবসাদ, ডায়ারিয়া, ওজন কমে যাওয়া, মুখের ভিতরের ইনফেকশন, যৌনরোগ। এইসব অবস্থায় চিকিৎসা না করাটাই হচ্ছে অসাবধানতা। এই অসাবধানতাই এসব রোগের মাধ্যমে আমাদের শরীরের Immune
System-কে নষ্ট করতে সাহায্য করে এবং ধীরে ধীরে তা অওউঝ-এর দিকে অগ্রসর হয়।
লক্ষণসমূহ: রাতে ঘাম ঝরে ভিজে যাওয়া, জ্বরের আবৃত্ত, অত্যধিক ডায়ারিয়া, জিব ও মুখে সাদা সাদা ফ্যাকাশে ছোপ, অত্যধিক অবসাদ, অত্যধিক ওজন কমা এবং অবশ্যই অস্বাভাবিক চর্মরোগের বৃদ্ধি। HIV-এর সংক্রমণ কীভাবে হতে পারে? অসুরক্ষিত যৌনসম্পর্ক করলে, এইচআইভি সংক্রমিত রক্ত নিলে, এইচআইভি জীবাণুযুক্ত সূঁচ/সিরিঞ্জ/বেøড ব্যবহারে, এইচআইভি (+ve) ব্যক্তির জীবাণুযুক্ত মশার কামড়ে।
আমাদের দেশে এইচআইভি (+াব) মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়, তবে জনসংখ্যার অনুপাতে চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেটে এই রোগের প্রভাব একটু বেশি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, বহির্দেশ বা জেলা থেকে আগত রোগীর সংখ্যা। তাছাড়া, বেকারত্বের জন্য এতদাঞ্চলের যুবকরা বাইরে কর্মসংস্থানের খোঁজে গিয়ে সেখানেও আক্রান্ত হয়। NACO (National AIDS Control Organisation)-এর তথ্য বলছে, সব দেশে যেখানে এই রোগের প্রভাব কমছে সেখানে গত বছর বিশ্ব এইডস দিবসে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, আমাদের দেশে কোনো কোনো জেলায় আজও এই রোগের প্রভাব কমেনি।
আমরা কীভাবে সুরক্ষিত থাকতে পারি? মহিলাদের ক্ষেত্রে এখানে কিছু কথা উল্লেখ করতে চাই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মহিলাদের শরীরে এই রোগের আক্রমণ পুরুষদের থেকেই হয়। যেমন, একজন পুরুষ, যার এক বা ততোধিক সঙ্গীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে তিনি জেনেশুনে বা অজান্তে একজন মহিলাকে বিয়ে করলেন। পরবর্তীতে কয়েক বছর পর দেখা গেল, গর্ভকালীন সময়ে রক্ত পরীক্ষাকালে ওই মহিলার শরীরে এইচআইভির জীবাণু রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে স্বামীও পজিটিভ রয়েছেন। অর্থাৎ অত্যধিক যৌনসম্পর্কের মাধ্যমে কখন তার শরীরে এইচআইভির জীবাণু প্রবেশ করেছে তিনি হয়তো জানেনই না। অথবা জানা সত্তে¡ও তিনি তার রোগ গোপন করে বিয়ে করেছেন। তাই একজন কাউন্সেলর হিসাবে আমি সব স্থানেই সজাগতামূলক অনুষ্ঠানে বলি, বিয়ের আগে যতই ধর্মীয় আচার-পদ্ধতি, নেন কোনো আপত্তি নেই, তবে তার সঙ্গে অন্তত পুরুষ এবং মহিলা উভয়েরই রক্তের এইচআইভি পরীক্ষা করানো অবশ্যই উচিত। এমন ঘটনা শুধু মহিলাদের ক্ষেত্রে নয়, পুরুষদের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। তাই সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে এই রক্তের পরীক্ষা করাতে পারেন।
রক্তদান জীবনদান, একথা আমরা সকলেই জানি। তবে সরকারি বিধিমতো রক্ত গ্রহণ না করলে তা থেকেও ছড়াতে পারে এইচআইভির জীবাণু। এখানে বলতে চাই যে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ব্লাড ব্যাংক থেকে যখন আমরা রক্ত নিতে যাই তখন তার বদলে এক বোতল রক্ত জমা রাখা বাধ্যতামূলক। কেবলমাত্র গর্ভবতী মায়েদের জন্য তা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এবং Exchange Free|। বিপিএল কার্ডধারীদের জন্য সরকারি অর্থরাশি মকুব হয়, বাকি সবক্ষেত্রেই ২৫০ টাকা (সরকারি হাসপাতালে) এবং ৫০০ টাকা (বেসরকারি হাসপাতালে) রোগীকে জমা দিতে হয় এবং এক বোতল রক্ত দিতে হয়। কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায়, সঠিক সচেতনতার অভাবে অনেকেই নিজের নিকটাত্মীয়কে ভয়ে রক্ত দিতে চান না। প্রয়োজনে ২০০০/৩০০০ টাকা খরচ করে অন্যান্য অপরিচিত ব্যক্তিকে ধরে নিজের পরিচিত পরিচয় দিয়ে রক্ত নিয়ে যান। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক, এইচআইভি ভাইরাস ৬ মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত Window period এ থাকে যখন এই রোগ শরীরে থাকলেও সাধারণ রক্ত পরীক্ষায় তা ধরা পড়ে না এবং এই রক্ত যারই শরীরে যাবে তিনি অদূর ভবিষ্যতে এইচআইভি (+ve) হবেনই। এসব অজানা তথ্যের অভাবে আমরা প্রায়ই দেখি মানুষ অপরিচিত লোকের থেকে রক্ত নিয়ে থাকেন যার পরবর্তী পরিণাম দাঁড়ায় ভয়াবহ। তাই সবাইকে অনুরোধ, একমাত্র সুপরিচিত ব্যক্তির থেকেই রক্ত নিন অথবা ব্লাড ব্যাংকে রক্ত জমা দিন। নইলে এ রক্ত জীবনদানের পরিবর্তে মরণ ডেকে আনবে।
যৌনরোগ, যৌন সম্পর্ক এইচআইভি থেকে বাঁচার উপায়- এই বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ যৌন-সম্বন্ধীয় আলোচনা আমাদের সমাজে এক অবাস্তব কল্পনা বললেই চলে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে সরকারি তথ্য মতে, আমাদের দেশে এইচআইভি ৮৭ শতাংশ ক্ষেত্রেই যৌনসম্পর্কের মাধ্যমে ছড়ায় যার অন্যতম কারণ হচ্ছে যৌনরোগ। সরকারি তথ্য মতে, আমাদের দেশে এইচআভি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কম। কিন্তু বেশির ভাগ লোকই এর চিকিৎসা করাতে লজ্জা অনুভব করেন অথবা সামাজিক অসম্মানের ভয়ে বলা এবং চিকিৎসা উভয় থেকেই দূরে থাকেন। আর এর লজ্জাই পরবর্তীতে ডেকে আনে নানা সমস্যা যার অন্যতম হচ্ছে HIV/ AIDS|।
পুরুষদের ক্ষেত্রে লক্ষণসমূহ: যৌনাঙ্গে ঘা, জ্বলন, চুলকানি, যৌনাঙ্গে ঘায়ের মধ্যে ধাতুর সমস্যা, ধাতু নিঃসরণ বা ধাতুর সমস্যা, পায়ুদ্বার থেকে নিঃসরণ, সিফিলিস হেপাটাইটিস বি, সি, ই, যৌনাঙ্গ ঝপধনরবং পোকার আক্রমণ, কুঁচকিতে Lymph
node ফোলা, যৌনাঙ্গে উকুন অন্যান্য।
মহিলাদের ক্ষেত্রে: সাদাস্রাবের সমস্যা, যৌনাঙ্গে ঘা, জ্বলন, অনাবশ্যক রক্তপাত হওয়া, তলপেটের অস্বাভাবিক ব্যথা, হারপিসজনিত রোগ, গর্ভপাত বারংবার হলেও যৌনরোগের সমস্যা থাকতে পারে, সিফিলিস, যৌনাঙ্গে Scabies পোকার আক্রমণ, যৌনাঙ্গে উকুন ইত্যাদি
উপরোক্ত সমস্যাগুলো অত্যন্ত মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে মানব শরীরে। এসব উপসর্গের চিকিৎসার মূল সমস্যা হচ্ছে সামাজিক ভয় এবং লজ্জা। এখানে আরও বলে রাখা উচিত যে, মহিলাদের সাদাস্রাবের চিকিৎসা শুধু এইচআইভির আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য কিন্তু নয়, বরং আমাদের জানা উচিত, সমস্ত বিশ্বে যখন স্তন ক্যানসারজনিত রোগের প্রভাব বেশি সেখানে আমাদের দেশে কিন্তু জরায়ু ক্যানসার রোগজনিত প্রভাব অনেক বেশি। তাই সাদাস্রাবের চিকিৎসা মহিলাদেরে যেভাবে এইচআইভি থেকে সুরক্ষা দেয়, তেমনি ক্যানসারের মতো জটিল সমস্যার কবল থেকেও বাঁচিয়ে রাখে। তাছাড়া, সিফিলিস নামক রোগ শরীরে থাকলে মহিলাদের বারবার গর্ভপাতও হতে পারে। কাজেই এই রোগের চিকিৎসা যেমন এইচআইভি থেকে বাঁচাবে তেমনি গর্ভাশয়ে শিশুমৃত্যুর হারও কমাতে পারে। তাই লজ্জা নয়, চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসাই হচ্ছে বাঁচার একমাত্র উপায়। এইসব রোগের চিকিৎসা সরকারি মেডিকেল কলেজে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এমনকি, সরকার থেকে প্রায় অনেক রোগের ওষুধও সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। তাই সবাইকে লজ্জা ছেড়ে এইচআইভির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার অনুরোধ জানাই।
সবশেষে সকলের কাছে অনুরোধ যে, এইচআইভি/এইডএসের নাম শুনে আতঙ্কিত না হয়ে, বরং সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা করান তবেই আমাদের সমাজ ও দেশ এইচআইভি মুক্ত হবে। ইংরেজিতে বলে, রোগ হওয়ার পর কাঁদার চেয়ে লজ্জা ছেড়ে সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন এবং সুস্থ থাকুন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন