বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না যে বার বার সরকার অথবা সরকারপন্থী মহলটি বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র এবং তার সুদের হারের ওপর আঘাত করেন কেন। এই আঘাতটি বিগত ৮/১০ বছর হলো পর্যায়ক্রমে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। সরকার তথা মহল বিশেষের এই আঘাত নিঃসন্দেহে দেশের গরীব, নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের ওপর আঘাত এবং বার বারই সেই আঘাতটি করা হচ্ছে দেশের উচ্চবিত্ত তথা বড়লোকদের স্বার্থে। জনাব আবদুল মতলুব আহমদ এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই দেশের ধনিক গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির জন্য হয়রান পেরেশান হয়ে গেছেন। পক্ষান্তরে ঐ একই মহল বড়লোকদের আরো বড়লোক করার জন্য গরীবদের বেঁচে থাকা তথা কিছুটা সচ্ছলভাবে বেঁচে থাকার সুযোগকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের সকলেই জানেন যে, দেশের ছোট ছোট ব্যবসায়ী এবং নিম্ন ও মধ্যম পর্যায়ের সরকারী এবং বেসরকারী কর্মচারীরা তাদের কষ্টকর দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কিছু সচ্ছলতা আনার জন্য ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ইনস্ট্রুমেন্ট প্রধানত দুটি। একটি হলো- ব্যাংকে স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদে তাদের আমানত গচ্ছিত রাখা। আরেকটি হলো- বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র ক্রয় করা। আমানত বিভিন্ন মেয়াদি হয়ে থাকে। তার মধ্যে প্রধান আমানত হলো স্থায়ী আমানত বা ফিক্সড ডিপোজিট (এফ ডি আর)। খুব বেশী দিন আগের কথা নয়। ৪/৫ বছর আগেও এফ ডি আরের সুদের হার ছিলো মেয়াদ ভেদে ৯ থেকে ১২ শতাংশ। সরকারী এবং বেসরকারী কর্মচারী ২৫/৩০ বা ৩৫ বছর চাকরি শেষে যে অবসর সুযোগ সুবিধা (রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট) পান সেই বেনিফিটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এফডিআরে জমা দিতেন। ফলে অন্তত ৩০/৪০ লাখ টাকা এফডিআরে রাখলে মাসে তারা কম করে হলেও ২৫/৩০ হাজার টাকা সুদ পেতেন। এর ফলে তাদের মূল পুঁজিতে যেমন হাত পড়তো না তেমনি মাস শেষে অল্প পরিমাণে হলেও তারা কিছু অতিরিক্ত আয় করতেন। এই অতিরিক্ত আয় থেকে তারা কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখতেন। তবে এই ক্ষেত্রেও তারা সুদের অংক পুরোটা পান না। কারণ, যাদের ইনকাম ট্যাক্স প্রদানের প্রমাণ বা টিন নাম্বার আছে তাদের নিকট থেকে ব্যাংকসমূহ সার্ভিস চার্জ হিসেবে মোট প্রদেয় সুদ থেকে বছরে ১০ শতাংশ টাকা কেটে নেয়। আর যাদের টিন নাম্বার নাই তাদের নিকট থেকে ১৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ কেটে নেয়।
আরেকটি ইনস্ট্রুমেন্ট হলো সঞ্চয়পত্র। এই সঞ্চয়পত্রে, বিশেষ করে পারিবারিক সঞ্চয়পত্রে অতীতে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দেওয়া হতো। সঞ্চয়পত্রে এইটুকু মুনাফা লাভের আশায় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা ঝাঁকে ঝাঁকে সঞ্চয়পত্র ক্রয় করেন। আজ সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে সরকার তথা ব্যাংক সমূহের লিকুইডিটি বা তারল্যের পরিমাণ ১ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনীতিবিদগণ ধারণা করে ছিলেন যে, এই বিপুল পরিমাণ তরল টাকা দেশে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা হবে এবং দেশে আর বিনিয়োগের টাকার কোনো অভাব হবে না। কিন্তু বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাঞ্ছিত ফলাফল পাওয়া গেল না। ব্যবসায়ীরা আবদার জুড়ে দেন যে, ব্যাংক থেকে তারা যে ঋণ গ্রহণ করেন সেটির সুদ (লেন্ডিং রেট) অনেক বেশী। লেন্ডিং রেট যতদিন বেশী থাকবে তত দিন তারা ব্যাংক থেকে তাদের চাহিদা মত ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন না। সুতরাং যদি দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হয়, যদি ঋণ প্রবাহ বাড়াতে হয়, তাহলে লেন্ডিং রেট কমাতে হবে। আর লেন্ডিং রেট কমাতে হলে আমানতের সুদের হারও কমাতে হবে। সেই ক্ষেত্রে অবধারিতভাবে ফিক্সড ডিপোজিট বা এফডিআর এবং সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমাতে হবে। ধনিক শ্রেণীর এই দাবি সরকার মেনে নেয়। এফডিআরের সুদের হার সাড়ে ১১ বা ১২ শতাংশ থেকে কমতে কমতে এখন পাঁচ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশে এসে ঠেকেছে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও ৮ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে স্থিত হয়েছে। এফডিআর বা সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার হ্রাস করানোর খড়গ চালালে কি হবে ব্যাংকের ঋণ প্রবাহ বলতে গেলে কিছুই বাড়েনি। এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট জনাব মতলুব আহমেদ এই তো সেই দিনও বলেছেন যে, লেন্ডিং রেটের সুদের হার ডাবল ডিজিট থেকে সিঙ্গল ডিজিটে নামিয়ে না আনা পর্যন্ত ঋণ প্রবাহ বাড়বে না, ফলে বিনিয়োগও প্রত্যাশা মত বাড়বে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে যে, আমানতের সুদের হার ৫ থেকে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার পরেও ঋণ প্রবাহ বলার মতো তেমন বাড়েনি। এর আগে বলা হতো যে ঋণ দেওয়ার মতো টাকা নাই। বলা হতো, দেশে রয়েছে বিরাট তারল্য সংকট। কিন্তু এখন আমানতকারীদের মাথায় বাড়ি দিয়ে তাদের আমানতের সুদের পরিমাণ ৫ থেকে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। তারপরেও কেন তরল অর্থ উপচে পড়ছে?
আসল কথা হলো, ধনাঢ্য ব্যক্তিরা চায় তাদের তেলা মাথায় আরো তেল দেয়া হোক। তারা বলতে গেলে মুফতে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চায়। লেন্ডিং রেট যদি ডাবল ডিজিট থেকে সিঙ্গল ডিজিটে নামিয়ে আনা হয় অর্থাৎ ১০ শতাংশের পরিবর্তে ৮ বা ৭ শতাংশ করা হয় তাহলে আমানতের রেট কত হবে? সাধারণ ব্যাংকিং নিয়ম অনুযায়ী সুদের হারের স্প্রেড অত্যন্ত ৪ শতাংশ হওয়া উচিত। লেন্ডিং রেট এবং ডিপোজিট রেটের ফারাককে বলা হয় স্প্রেড। আজ যদি লেন্ডিং রেট ৮ এ নামিয়ে আনা হয় তাহলে ডিপোজিট রেট হবে ৪ শতাংশ। এই সুদের হারে তখন কি আর কেউ ব্যাংকে টাকা রাখবে? নাকি সঞ্চয়পত্র কিনবে? এমন অবস্থায় গরীব, নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের পক্ষে ফতুর হওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকবে না। ছোট্ট ব্যবসায়ী এবং মধ্যম পর্যায়ের চাকরিজীবীদের সৎ পথে অতিরিক্ত আয়ের আরেকটি রাস্তা ছিলো শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা। এই সরকারের আমলে সেই শেয়ার বাজার ধ্বংস হয়ে গেছে। শেয়ার বাজারে টাকা খাটিয়ে ৩০ লক্ষ মানুষ এখন পথের কাঙাল। এদের মধ্যে তিন জন অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যা করেছেন। এখন যদি বিত্তশালীদের চাপে লেন্ডিং রেট কমানোর জন্য ডিপোজিট রেট আরো কমানো হয় তাহলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং ছোট্ট ছোট্ট চাকরিজীবীদের সামনে ফকির হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর বিরুদ্ধে শুধুমাত্র সাধারণ মানুষ নন, সরকারের অভ্যন্তরেও এখন কেউ কেউ প্রতিবাদ করছেন। সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন মন্ত্রী হলেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। তিনিও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর প্রবল বিরোধিতা করেছেন। এসবের প্রেক্ষিতে জনগণের প্রত্যাশা, অর্থমন্ত্রী জনগণের আর্তনাদ শুনবেন এবং আমানত ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার না কমিয়ে বরং কিছুটা বৃদ্ধি করে গরীব ও মধ্যবিত্তকে বাঁচাবার উদ্যোগ নেবেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন