শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ট্রানজিটে হতাশা ও জনসংক্ষোভ

প্রকাশের সময় : ২৫ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জঙ্গি ও গুপ্তঘাতক দমনের নামে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান ও গণগ্রেফতারের মধ্য দিয়ে দেশে যখন এক ধরনের আতঙ্কজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, ঠিক তখন (১৫ জুন) অনেকটা নীরবেই আশুগঞ্জ নৌবন্দরে ১ হাজার মে. টন লৌহজাত সামগ্রী পরিবহনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে সারাদেশে গণগ্রেফতার চলার সময় ট্রানজিট নিয়ে রাজনৈতিকদল ও নাগরিক সমাজ তেমন কোন উচ্চবাচ্য না করলেও নামমাত্র ট্রানজিট ফি’র বিনিময়ে ভারতীয় ট্রানজিটের বিপক্ষে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও অসন্তোষ বেড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি বিরোধী রাজনৈতিক মহলও বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠতে শুরু করেছে। চারদেশীয় সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্কের নামে মূলত ভারতীয় ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে এক লক্ষকোটি টাকার বেশী বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তার কথা ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। ট্রানজিটকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম বন্দর, আশুগঞ্জ নৌ-বন্দর ও আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত সড়ক ও অবকাঠামো উন্নয়নের অর্থনৈতিক চাপ নিজের উপর নিয়েও বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে ন্যূনতম ট্রানজিট ফি পাচ্ছে না। দেশের মানুষ অবাক বিস্ময়ে দেখছে, টনপ্রতি মাত্র ১৯২ টাকা মাশুলে ভারতকে অবাধে ট্রানজিট দিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে এই ধারণা বিস্তার লাভ করছে যে, বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার ভারতের সমর্থন অব্যাহত রাখতেই দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে নামমাত্র শুল্কে ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছে।  
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে বাকি অংশের স্থল যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহন সহজ করতে ভারত দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের উপর দিয়ে একটি ট্রানজিট, আসলে করিডোর প্রত্যাশা করছিল। বাংলাদেশ ও ভারতের আভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা’ সম্ভব ছিল না। বিশেষত যৌথনদীর উজানে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার ও বাঁধ নির্মাণ, গঙ্গা, তিস্তাসহ যৌথ নদীর পানি বণ্টনে অনীহা, সীমান্তে বিএসএফ’র প্রতিনিয়ত বাংলাদেশী হত্যা এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ভারতের একপেশে নীতি ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভারতবিদ্বেষী মনোভাব সৃষ্টির বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি তথা ভারতসহ প্রতিবেশীদের সাথে আন্তঃসম্পর্কের নীতি সব সময়ই বন্ধুত্বপূর্ণ। বিশেষত বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ভারতের কংগ্রেসের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক সুসম্পর্কের ঐতিহ্য রয়েছে। এ কারণেই বাংলাদেশে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ভারতের তৎকালীন ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের সাথে দুই দেশের অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর সমাধানে এ দেশের জনপ্রত্যাশা বেড়ে গিয়েছিল। ভারতের সাথে বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রে বন্ধুত্বের প্রমাণ দিলেও তিস্তা চুক্তিসহ অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ এবং আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মত ইস্যুগুলোতে বাংলাদেশের উদ্বেগ ও দাবীর প্রতি ভারত কখনো ইতিবাচক মনোভাবের প্রমাণ দিতে পারেনি।  
মূলত ৫ বছর ধরেই অনানুষ্ঠানিকভাবে বিনাশুল্কে ভারতীয়রা বাংলাদেশের উপর দিয়ে নৌ ও স্থল ট্রানজিট সুবিধা ভোগ করছে। ট্রানজিটের জন্য ভারতীয় প্রস্তাবে রাজী হওয়ার পরই বাংলাদেশ সরকার ট্রানজিট ফি নির্ধারণের তৎকালীন ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে সেই কমিটি প্রথমে ৪ ডলার থেকে ৫০ ডলারের (৩২০ টাকা থেকে ৪০০০ টাকা) মধ্যে ফি নির্ধারণের সুপারিশ করলেও চূড়ান্ত প্রস্তাব আকারে টন প্রতি ১০৫৮ টাকা ট্রানজিট ফি নির্ধারণের সুপারিশ করেছিল। কমিটির সুপারিশকৃত এই ট্রানজিট ফি’কে অনেকেই অপ্রতুল বলে মন্তব্য করেছিল। যেখানে কলকাতা থেকে একটি পণ্যবাহী ট্রাক ত্রিপুরায় পৌঁছতে বিপদসঙ্কুল পথে কমপক্ষে ৩০ দিন সময় লাগে এবং টনপ্রতি ২০০ ডলারের বেশী খরচ পড়ে সেখানে বাংলাদেশের সকল অবকাঠামো ব্যবহার করে মাত্র ৭ দিনে এবং তিনভাগের একভাগ খরচে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য পৌঁছে দেয়া সম্ভব। এত সুবিধার পরও ট্রানজিট ফি দিতে ভারতের অস্বীকৃতিকে এ দেশের মানুষ তাদের বড়ভাইসুলভ বা আধিপত্যবাদী আচরণ হিসেবেই গণ্য করছে। ভারতের প্রতি সরকারের নতজানু নীতির কারণেই এটা সম্ভব হচ্ছে বলে মনে করছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। বিশ্বায়নের এই যুগে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক  ট্রানজিট ও কানেক্টিভিটির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। এ ধরনের পরিবহন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সকল দেশই লাভবান হয়ে থাকে। ট্রানজিটের দ্বারা বাংলাদেশও অর্থনৈতিকভাবে বিপুল লাভবান হবে বলে এক সময় বলা হয়েছিল। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রানজিট শুরুর পর থেকে এখন দেশের ব্যবসায়ীরা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে নিজেদের রফতানী ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের বাজার হারানোর আশঙ্কা করছেন। ট্রানজিটের মধ্য দিয়ে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের টার্গেটসহ বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি, বন্দরসহ অবকাঠামোখাতে বাড়তি চাপ, বাণিজ্যিক ক্ষতির বাস্তবতা সত্ত্বেও ট্রানজিট ফি নির্ধারণে দেশীয় বাস্তবতা ও আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার ভারতের এমন একপেশে মনোভাব শেষ পর্যন্ত হিতে বিপরীত হতে পারে। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে দেশের মানুষ আপস করবে না এবং দীর্ঘদিন চুপ থাকবে না। এ কথা সরকার এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে মনে রাখতে হবে। যেভাবেই হোক, ভারতের প্রত্যাশা পূরণে বাংলাদেশ কোন কার্পণ্য করেনি। এখন যৌক্তিক পর্যায়ে ট্রানজিট ফি নির্ধারণে বাংলাদেশ ও ভারতের সরকারকে সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে পুনরায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন