দেশে চাহিদা সম্পন্ন কসমেটিকসের শতকরা ৭০ ভাগই নকল। নকল কসমেটিকস দেদারছে উৎপাদিত হচ্ছে এবং ব্যবহারকারীরাও শনাক্ত করতে না পেরে নিয়মিত ব্যবহার করে চলেছে। এর ফলে তারা যে নীরবে ত্বকের ক্যান্সারসহ ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, তা বুঝতে পারছে না। রাজধানীসহ এর আশপাশে বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য কারখানায় নকল কসমেটিকস উৎপাদিত হচ্ছে। এসব কারখানায় দেশি-বিদেশিসহ এমন কোনো নামী-দামী ব্র্যান্ডের কসমেটিস নেই যা উৎপাদন হচ্ছে না। কেউ দেখলে বুঝতেই পারবে না, এগুলো নকল। এসব নকল কসমেটিকসই চলে যাচ্ছে অভিজাত এলাকার বিভিন্ন ব্র্যান্ডেড দোকানে। ক্রেতারা বুঝতেই পারে না, কোনটি নকল আর কোনটি আসল। তারা ব্র্যান্ড ও দোকানদারদের উপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখেই কিনে নিয়ে যায়। আসল না নকল, তা পরখ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না। কারণ, এখানে বিশ্বাসটাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বিশ্বাসের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এসব নকল কসমেটিকস ব্যবহার করে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। অনেক সময় ত্বকে কালচে ভাব বা জ্বলে যাওয়া এবং চুলকানি ও লাল হয়ে যাওয়া থেকে অনেক মনে করেন ব্র্যান্ডের কসমেটিকসটি হয়তো এক্সপায়ারড হয়ে গেছে বা ব্যবহারে নিজের বেখেয়ালের কারণে এমনটি ঘটেছে। ব্র্যান্ডের প্যাকেজ ও কৌটা ঠিক থাকলেও ভেতরের উপাদান যে নকল, এটা কিছু ক্রেতা একেবারেই বিশ্বাস করতে চায় না। ব্র্যান্ডের উপর থেকে সহজে আস্থা হারাতে চায় না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, অধিকাংশ দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের কসমেটিকসই নকল। এসব নকল কসমেটিকস ফুটপাত থেকে অভিজাত মার্কেটের দোকানে আকর্ষণীয়ভাবে থরেথরে সাজানো থাকে।
নিজেকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তোলার কম-বেশি প্রবণতা সবার মধ্যেই রয়েছে। আধুনিক যুগে এসে মানুষ তার সৌন্দর্যের প্রতি আরো অধিক মনোযোগী হয়ে উঠেছে। সৌন্দর্য প্রকাশে চেষ্টার কোনো ত্রুটি সচরাচর সে করে না। মানুষের এই সৌন্দর্য চর্চা ও রূপ-লাবণ্য ফুটিয়ে তুলতে প্রায় প্রতিনিয়ত সারা বিশ্বে কৃত্রিম কসমেটিকসের উৎপাদন চলছে। সুন্দর, মসৃণ ও ফর্সা হওয়ার ক্রিম থেকে শুরু করে ত্বকে বয়সের ছাপ প্রতিরোধক ক্রিম নামী প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন করছে। এর সাথে স্যাম্পু, বডি স্প্রে, পারফিউম, সাবান, ময়েশ্চারাইজার ক্রিম, ভেসলিন, ফেসপ্যাক থেকে শুরু করে হেন কোনো কসমেটিকস নেই যা উৎপাদন করছে না। সৌন্দর্য পিয়াসীদের কাছে এগুলোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এসব কসমেটিকস উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান খ্যাতি অর্জন করেছে। কোয়ালিটির কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যও রূপসচেতন মানুষের কাছে বেশি সমাদৃত। এগুলো ব্র্যান্ডেড আইটেম হিসেবে পরিগণিত হয়। বাংলাদেশেও এসব প্রতিষ্ঠানের পণ্য পাওয়া যায়। ব্যবহারকারীরাও ব্র্যান্ড দেখে নিশ্চিন্তে কিনে নিয়ে যায়। অথচ বর্তমানে বাজারে যেসব কসমেটিকস পাওয়া যাচ্ছে, এগুলোর বেশির ভাগই নকল। এতে রূপসচেতন মানুষ ত্বকের অ্যালার্জি থেকে শুরু করে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এসব নকল কসমেটিকসের উপাদানে যে আনুপাতিক হারে কেমিক্যাল মিশ্রণ থাকার কথা, তা থাকে না। নকলকারীরা তা কখনোই করতে পারে না। কেবল ঘ্রাণ ও আসল কসমেটিকসের সাথে দেখতে হুবহু মিশ্রণ তৈরি করে বাজারজাত করছে। এসব নকল কসমেটিকসেই এখন বাজারে অবাধে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীসহ এর আশপাশের এলাকায় গড়েওঠা কারখানা শুধু বিদেশি কসমেটিকস নয়, দেশি প্রতিষ্ঠানের কসমেটিকসও হরদম নকল করছে। ফলে বাজারে দেশি-বিদেশি উভয় কসমেটিকসের কোনটি আসল আর কোনটি নকল ক্রেতারা তা সহজে ধরতে পারছে না। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের রূপচর্চাকারীদের বেশিরভাগই বিদেশি কসমেটিকসের উপর আস্থাশীল। তারা মনে করে, দেশি কসমেটিকসের চেয়ে বিদেশি কসমেটিকস অধিক মানসম্পন্ন। তবে অনেকে এ কথা মানতে বা বুঝতে চান না, সাধারণত কসমেটিকস-এর উপকরণ ও উপাদান যে কোনো দেশের বা অঞ্চলের আবহাওয়ার উপর ভিত্তি করে ঠিক করা হয়। একই ব্র্যান্ডের কসমেটিকস গরমের দেশের জন্য একরকম, শীত ও নাতিশীতোষ্ণ দেশের জন্য আরেক রকম করে উৎপাদন করা হয়। এখন শীতের দেশের জন্য উৎপাদিত কসমেটিকস গরমের দেশে ব্যবহার করলে তাতে রিঅ্যাকশন দেখা দেয়াই স্বাভাবিক। তার উপর যদি তা নকল হয়, তবে তা ভয়াবহ হয়ে দেখা দেয়ার কথা। আমাদের দেশে আমদানিকৃত কসমেটিকসের কেমিক্যাল টেস্ট যেমন করা হয় না, তেমনি কোনটি নকল আর কোনটি আসল এই পরীক্ষা করারও কোনো ব্যবস্থা নেই। এই সুযোগে নকলকারীরা বিশ্বের নামী-দামী ব্র্যান্ডের কসমেটিকস বেশুমার উৎপাদন করে চলেছে। ক্রেতারাও এগুলো শনাক্ত করতে না পেরে ব্যবহার করে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। এতে তারা ত্বকের ক্যান্সার, শ্বাসনালীর ক্ষতি, চোখের ক্ষতি, বিষণœতা, অ্যালার্জি সমস্যা এমনকি কিডনী ও ফুসফুসের মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছ। এসব নকল কসমেটিকসে আবার আসল কসমেটিকস ব্যবহার করা কৌটা ও প্যাকেট ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যবহারকারীরা কসমেটিকস ব্যবহারের পর এসব কৌটা ফেলে দিলে তা টোকাইদের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। তবে বেশিরভাগ সময়ই তারা কৌটা উৎপাদন করে নকল করে থাকে। বাজারে এসব নকল কসমেটিকস অবাধে বিক্রি হলেও, এগুলোর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায় না।
জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে নকল কসমেটিকস। নীরবেই অসংখ্য মানুষ ত্বকের মারাত্মক সংক্রমণসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সৌন্দর্য পিয়াসী ও রূপসচেতন মানুষের আকাক্সক্ষা ধ্বংস এমনকি জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে নকল কসমেটিকস সামগ্রী। রাজধানীসহ এর আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠা এই নকল কারখানাগুলো গুঁড়িয়ে দিতে না পারলে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে বোঝায় পরিণত হবে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে এখনই সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে এসব নকল কারখানা উচ্ছেদ এবং এর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শুধু সাময়িক জেল-জরিমানা করলেই হবে না, এদের বিরুদ্ধে আরো কঠিন শাস্তির বিধান করতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো রকম ছাড় দেয়া যাবে না। এর পাশাপাশি কসমেটিকসের মান নিয়ন্ত্রণে প্রস্তাবিত যে নীতিমালা রয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে বাজার থেকে কসমেটিকসের সেম্পল সংগ্রহ করে নিয়মিত মান পরীক্ষার ব্যবস্থা এবং যেগুলোতে ভেজাল পাওয়া যাবে, সেগুলোর নাম প্রকাশ করতে হবে। মানুষের সৌন্দর্য চর্চাকে পুঁজি করে যারা নকল কসমেটিকস উৎপাদন ও বাজারজাত করছে, তাদের কোনোভাবেই রেহাই দেয়া যাবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন