শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

পরোক্ষভাবে গণহত্যার কথা স্বীকার করেছেন সু চি

আইসিজে’তে শুনানি সমাপ্ত

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

মিয়ানমারের বক্তব্য ‘মিথ্যাচার’ সেনাবাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা নেই
অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি


অবশেষে শেষ হলো বহুল আলোচিত রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার শুনানি। নেদারল্যান্ডসের হেগে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিজে) গতকাল বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিনের শুনানির শুরুতে বক্তব্য তুলে ধরেন গাম্বিয়ার পক্ষের আইনজীবী পল রাইখলার। তিনি মিয়ানমারের নেত্রী সু চির বুধবার দেয়া বক্তব্যের বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন করেন। মিয়ানমারের বক্তব্য ‘ফ্রড’ বা মিথ্যাচার বলে অভিহিত করে এদিন তিনি দাবি করেন- নিজের বক্তব্যে গণহত্যার কথা খুব চতুরতার সঙ্গে এড়িয়ে গেলেও, পরোক্ষভাবে ঠিকই স্বীকার করেছেন মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের প্রধান অং সান সু চি।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে করা গাম্বিয়ার মামলার তিনদিনের শুনানির শেষ দিন ছিল গতকাল। এদিন সু চি’র বক্তব্য বিশ্লেষণ করে পল রাইখলার বলেন, মিয়ানমারের আইনজীবী গণহত্যার উদ্দেশ্য প্রমাণের জন্য সাতটি নির্দেশকের কথা বলেছেন। যা গাম্বিয়ার আবেদনেও রয়েছে। এগুলো মিয়ানমার অস্বীকার করেনি। এরপর তিনি যোগ করেন, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি আদালতে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। আদালত নিশ্চয়ই বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন। তাছাড়া সু চি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) কথা বলতে গিয়ে তাদের মুসলিম হিসেবে তুলে ধরেছেন। আশা করি, আদালত এই মামলার রায় প্রদানের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখবেন। আইনজীবী রাইখলার মিয়ানমারের বক্তব্য ‘ফ্রড’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেছেন, মিয়ানমার নিজেই স্বীকার করেছে যে খুব সামান্য সংখ্যায় উদ্বাস্তু ফিরেছে। রাইখলার বলেন, মিয়ানমারের আইনজীবী ওকোয়া প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ এবং চীন, জাপান ও ভারতের সহায়তার বিষয়টিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এ দেশগুলো প্রত্যাবাসন চায়। কিন্তু প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব মিয়ানমারের। মিয়ানমার সেটি পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপরে চালানো নৃশংসতার জন্য সৈন্যদের বিচারের বিষয়ে মিয়ানমারকে বিশ্বাস করা যায় না মন্তব্য করেন এই আইনজীবী বলেন, কিভাবে এটা বিশ্বাস করা সম্ভব যে, তাতমাদাও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ স্বীকার করবে এবং জড়িত সৈন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে যখন জাতিসংঘের তদন্তে সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ, সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং সহ শীর্ষস্থানীয় ছয় জেনারেলই ‘গণহত্যার’ জড়িত বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে বিচারের সুপারিশ করা হয়েছে। ১৭ বিচারকের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, গণহত্যার ভয়াবহতা বিচারে সেখানে সহিংসতা বন্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

রাইখলার বলেন, যেসব নবজাতককে মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নদীতে ছুড়ে ফেলা হয়েছে তাদের মধ্যে কয়জন সন্ত্রাসী ছিল? গণহত্যাকে অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘর্ষ উল্লেখ করে চাপা দেওয়া যাবে না। সু চির উদ্দেশে গাম্বিয়ার আরেক আইনজীবী ফিলিপে স্যান্ডস বলেন, ‘ম্যাডাম এজেন্ট, আপনার নীরবতা উচ্চারিত শব্দের চেয়েও অনেক বেশি কথা বলছে। একসময় ধর্ষণ নিয়ে খুব সরব ছিলেন। কিন্তু এখন এত নীরব কেন?’

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা জোরদার করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। হত্যাকা-, ধর্ষণ ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের মুখে জীবন ও সম্ভ্রম বাঁচাতে নতুন করে ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। গত ১১ নভেম্বর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সরকারের নৃশংসতাকে ‘গণহত্যা’ অ্যাখ্যা দিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে গাম্বিয়া। আদালত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেন। শুরুতে আন্তর্জাতিক আদালতের দেওয়া তদন্তের নির্দেশ প্রত্যাখ্যানের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত মামলা লড়ার ঘোষণা দেয় মিয়ানমার সরকার।

এই মামলার শুনানিতে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দেশটির রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি। গত মঙ্গলবার শুনানির প্রথমদিনে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরে গাম্বিয়া। পরদিন বুধবার নোবেলজয়ী নেত্রী সু চি মিয়ানমারের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরেন। নিজের বক্তব্যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনা গণহত্যার সব অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।

তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে মিয়ানমারের বাহিনীর তৎপরতা শুরু হওয়ার পর সাত লাখ চল্লিশ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপুঞ্জ প্রাথমিক তদন্তের পর বিষয়টিকে ‘জাতিনিধন’ বলে ঘোষনা দিয়েছে। প্রত্যাশিত ভাবেই সু কি সে অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখান করে বলেন, ‘রাখাইন প্রদেশের সমস্যা অত্যন্ত জটিল ও বোঝা দুরূহ...প্রাচীন আরাকান রাজত্বের দ্বারা অনুপ্রাণিত আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) স্বাধীন রাখাইন প্রদেশের দাবি করে।’ বিষয়টি বোঝাতে সু কি সংঘর্ষের ইতিহাস বলতে শুরু করেন। তার কথায়, এ বারের সংঘর্ষ আরম্ভ হয় ২০১৬ সালের শেষ দিকে শুরু হলেও চরমে ওঠে ২০১৭ সালের আগস্টে। জঙ্গিরা মঙ্গদ শহর দখলের চেষ্টা করলে সন্ত্রাসদমন অভিযানে বাধ্য হয় মিয়ানমার সেনা, যুক্তি সু কি-র। কিন্তু জাতিনিধন, গণধর্ষণ, নির্বিচারে খুন, বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া সে সব কেন? এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের সীমাবদ্ধতা মনে করিয়ে দেন মিয়ানমারের অন্যতম জনপ্রিয় নেত্রী। ওই আইনে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট দেশের অভ্যন্তরীণ বিচারব্যবস্থার পরিপূরক হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনে বিচার হতে পারে। সে প্রসঙ্গেই সু কি-র দাবি, মানবাধিকার আদৌ লঙ্ঘন হয়ে থাকলে মিয়ানমার নিজেই তার তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেবে। তার আরও দাবি, ইতিমধ্যে আমজনতাকে মেরে ফেলায় শাস্তি পেয়েছেন সেনাবাহিনীর একাধিক সদস্য।

দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, রায় ঘোষণা করা হবে শুনানি শেষ হওয়ার পরবর্তী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে। রায়ে আন্তর্জাতিক আদালত মিয়ানমারকে যে নির্দেশ দেন, তা পরবর্তী চারমাসের মধ্যেই বাস্তবায়ন করতে হবে। আর যদি মিয়ানমার তা পালনে ব্যর্থ হয়, তবে আদালত ব্যবস্থা নেবেন। সূত্র : রয়টার্স, আল-জাজিরা।

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন