সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা ও কর্মরত ডাক্তারদের ভূমিকা, আচরণ, দালালদের সাথে সখ্য নিয়ে ইতোপূর্বেও লেখেছি। দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা বা বিভাগীয় সরকারি হাসপাতালের পাশে নিয়ম বহির্ভূত ও অবাধে গড়ে উঠছে অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এই সব প্রতিষ্ঠানে সেবা দিয়ে থাকেন সরকারি হাসপাতালে কর্মরত বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞরা। তাদের আবার রয়েছে নিজস্ব চেম্বার অথবা কোনো বড় ফার্মেসির একটা কোণে বসে রোগী দেখার ব্যবস্থা। এভাবেই চলছে দেশের চিকিৎসা সেবা। বিষয়টা বর্তমানে ‘রোগীর চেয়ে ডাক্তার বেশি’ অনেকটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এই ডাক্তারদের কেবল সরকারি হাসপাতালের বাইরেই পাওয়া যায়। মফস্বল এলাকা থেকে শুরু করে জেলা ও বিভাগীয় সকল এলাকায় ডাক্তারদের পরিচিতি, মোটা মোটা ডিগ্রি, এটা-ওটা সুবিধা, রোগী দেখার ভেন্যু ইত্যাদি সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য মাইকিং করে জানানোর সংস্কৃতি এদেশে বেশ পুরনো। প্রতিষ্ঠিত ডাক্তারগণ তাদের সরকারি হাসপাতালকে সাইনবোর্ড আকারে ব্যবহার করলেও সরকারি হাসপাতালে সময় ব্যয় করাকে তাঁরা জীবনের মূল্যবান সময়ের অপচয় বলে মনে করেন। তাঁরা মানুষের যে সেবা করেন না তা নয়। তাঁরা মানুষেরই সেবা করেন তবে তা বেসরকারি ক্লিনিকে, উচ্চমূল্যের বিনিময়ে। তবে সব ডাক্তাররাই এমন নন। হাতেগোনা কিছু সত্যিকারের ডাক্তারও রয়েছেন, যারা ছোটবেলায় হয়ত তাদের জীবনের লক্ষ্য যেমনটা রচনায় লিখেছিলেন ভালো ডাক্তার হবেন, জনসেবা করবেন কাজের বেলায়ও সাধ্য অনুযায়ী তার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ একটি দরিদ্র দেশ আর এখানে খাবার-দাবারে ভেজাল, আবহাওয়াগত নানা কারণে রোগ-শোকও বেশি। আগের তুলনায় এখন দেশের সকল উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে আধুনিক হাসপাতাল হয়েছে, আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা হয়েছে, নিয়োগ দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় ডাক্তার। ইতোপূর্বে কর্মস্থলে ডাক্তারদের গ্রামে না যাওয়া বা তাঁদের অনুপস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কঠোর পদক্ষেপের কথাও শুনিয়েছেন। এই ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি হলেও বাকিটা যেই লাউ সেই কদুই রয়ে গেছে। যারা রাজনৈতিক পেশাজীবী সংগঠনের মদদ পায়, তাদের জন্য অন্য কোনো অভিভাবক লাগে না, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহীর হুঁশিয়ারিও কাজ দেয় না। সাধারণ দরিদ্র জনগণ ভালো চিকিৎসার আশা নিয়ে বড় শহরে গিয়ে সর্বস্বান্ত ও নিঃস্ব হয় দালালদের খপ্পরে পড়ে। টাকা ছাড়া এখানে ভালো কিছু পাওয়ার আশা তারা করতে পারে না। এখানকার ডাক্তাররাই আবার বাইরে ব্যক্তিগত চেম্বারে বা বেসরকারি কোনো হাসপাতালে ভুক্তভোগী রোগীদের দেখছেন ইচ্ছেমতো ফি নিয়ে। উপজেলা পর্যায়ে মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও জেলা বা বিভাগীয় শহরে সেটা দ্বিগুণ বা তিনগুণেরও বেশি। কেউ কেউ নিচ্ছেন ৬০০, ৭০০, ১,০০০ বা ১,৫০০ টাকা পর্যন্ত। সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৪ মিনিট বা তারও একটু বেশি সময় রোগীকে পরামর্শ ও কিছু ঔষধ লিখে এত টাকা নেওয়ার নিশ্চয়ই কোনো যৌক্তিকতা নেই! এই ফী নির্ধারণের কোনো নিয়ম নেই। দ্রæতই সরকার কর্তৃক সহনীয় পর্যায়ের স্তরভেদে নির্দিষ্ট ফী নির্ধারণ করা ভুক্তভোগীদের দাবি। সরকারি হাসপাতাল এবং নিজ চেম্বারে বসেও ছোটখাট কারণে রোগীদেরকে তাঁদের মনোনীত কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো হয় বেশ কতগুলো টেস্ট দিয়ে। এই সুযোগে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো ইচ্ছামতো চার্জ নিচ্ছে। আবার প্রয়োজনে কেবিন নিলে সেখানে আকাশ ছোঁয়া ভাড়া। ফলে সেবা নিতে আসা দরিদ্র রোগীরা রীতিমত হিমশিম খান। হয়ে পড়েন অনেকেই নিঃস্ব ও ঋণগ্রস্থ। কারও আর্থিক অবস্থা বুঝার সময় নেই ডাক্তার বা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের। তাঁরা জল্লাদের মতো রোগীদের গলা কেটেই যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। সবশেষে ডাক্তাররা নিজ পছন্দের কোম্পানির দরকারি ঔষধের ভীড়ে অদরকারি কিছু ঔষধও লিখে দিচ্ছেন। এভাবেই তাঁরা সঠিক সরকারি চিকিৎসার পরিবর্তে উচ্চ মূল্যে সর্বক্ষেত্রেই গলাকাটা বাণিজ্য করে যাচ্ছেন। আবার ঔষধের মূল্য নিয়েও রয়েছে কারসাজি। একেক জায়গায় একেক দাম। প্রেসক্রিপশন দেখে ফার্মেসিওয়ালারা ঔষধের দাম ধরে বসেন অনেক বেশি। কারণ ঔষধের দাম দুই-একজন ছাড়া সাধারণ মানুষের কখনোই বুঝার বা জানার কথা নয়। পাতার মধ্যে খোদাই করে মেয়াদ ও উৎপাদনের তারিখ থাকলেও নেই দামের বিষয়টি। পত্র-পত্রিকায় দেখা গেছে, ইতোপূর্বে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইনজেকশন, বমির ঔষধ, অস্ত্রোপচারের সেলাই-সুতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে সাধারণ রোগীদের কাছ থেকে প্রকৃত দামের তুলনায় বহুগুণ বেশি টাকা নেয়া হয়েছে।
আমাদের সমাজ আজ মূল্যবোধহীনতার গভীরে নিমজ্জিত। অর্থ-বিত্ত, লোভ আর ক্ষমতার মোহ আমাদের আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। আমাদের সুকুমার বৃত্তিগুলো পশুশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তাই বিবেক ও মনুষ্যত্ববোধের দ্বৈত শক্তির বলে এখান থেকে ডাক্তারদের বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ ইহকাল-পরকালে জবাবদিহি বলতেও একটা বিষয় আছে। এই ডাক্তাররূপী মানুষগুলো যাদের পিছনে দেশ এত বেশি বিনিয়োগ করেছে তাঁদের কাছ থেকে অসুস্থ মানুষগুলো কি এতটুকু আশা করতে পারে না? সরকার কর্তৃক মাত্র ১১৭টি ঔষধের দাম নির্ধারিত থাকলেও নিত্য নতুন হাজারো ঔষধের দাম কোম্পানিগুলো নিজ থেকেই নির্ধারণ করে থাকে। তাই জনস্বার্থে দ্রুতই সকল ঔষধের মূল্য নির্ধারণ করে পাতায়ও খোদাই করে দাম প্রদর্শন এবং ক্লিনিকগুলোতে সকল ধরনের টেস্টের চার্জ নির্ধারণ করার ব্যাপারে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: প্রকৌশলী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন