শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ইইউ থেকে ব্রিটেনের বিদায়

প্রকাশের সময় : ২৬ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অবশেষে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ছাড়ার পক্ষেই রায় দিয়েছে ব্রিটেনের জনগণ। ২৩ জুন অনুষ্ঠিত গণভোটে ৫১ দশমিক ৯ শতাংশ ভোটার ইইউ থেকে বের হয়ে আসার পক্ষে ভোট দিয়েছে। বাকীরা থাকার পক্ষে রায় দিয়েছে। ব্যবধান খুব বেশী না হলেও এই গণভোটকে পর্যবেক্ষক মহল ঐতিহাসিক ও দিগ পরিবর্তনকারী বলে মনে করছে। অতঃপর ইইউতে ব্রিটেনের আর থাকার কোনো সুযোগ নেই। গণভোটের রায়ই তার স্থান ও অবস্থান নির্ণয় করে দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় দেশগুলোর নেতারা ঐক্যবদ্ধ ইউরোপ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্ম হয়। এই প্রথম এই সংস্থা থেকে কোনো সদস্য দেশ গণভোটের মাধ্যমে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিল। বিগত বহু বছরে ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে নানা ক্ষেত্রে সম্পর্কের উন্নয়ন ও সহযোগিতার বিস্তার যেমন হয়েছে, তেমনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিমত ও টানাপোড়নও লক্ষ্য করা গেছে। আজ এই সূত্রবদ্ধ মালা থেকে একটি দেশ বসে পড়লো। ইইউতে থাকা ও না থাকার প্রশ্নে ব্রিটেনের জনগণ প্রায় সমসংখ্যায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। গণভোটের ফলাফলেও সেটা ধরা পড়েছে। অনেকেই এমনটা মনে করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত গণভোটের রায় ইইউতে থেকে যাওয়ার পক্ষেই আসবে। একেবারে শেষ দিকের জরিপেও এরকম আকাক্সক্ষাই উঠে এসেছিল। তবে থাকা না থাকার পক্ষের ব্যবধান ছিল সামান্য। বলা হয়, ব্রিটিশ অত্যন্ত প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ জাতি। তার দূরদৃষ্টি ও দূরদর্শিতার বহু পরিচয় ইতিহাসে বিবৃত হয়ে আছে। এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয়েছে, অনেকেই তা মনে করেন না। যারা ইইউতে থেকে যাওয়ার পক্ষে, তারা রায়ে হতাশাক্রান্ত ও দুঃখিত হলেও যারা বেরিয়ে আসার পক্ষে তারা উদ্দীপ্ত ও খুশী হয়েছে। তারা গণভোটের রায়কে স্বাধীনতার পক্ষে রায় বলে চিহ্নিত করেছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তার দিক থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন ইইউতে থেকে যাওয়ার। তার চেষ্টা কাজে আসেনি। তার দলের নেতাকর্মীদের একটা বড় অংশ এমনকি মন্ত্রিসভার কিছু সদস্যও ইইউ ছাড়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তারা সফলকাম হয়েছেন। ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। বিরোধী নেতা জেরেমি করবিন এবং প্রধান প্রধান দলের প্রথম সারির আরও অনেক নেতা একজোট হয়ে ইইউতে থাকতে চাইলেও জনগণের বৃহদাংশ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। জেরেমি করবিন বিরোধীদলীয় নেতার পদে থাকবেন কিনা কিংবা থাকতে পারবেন কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
গণভোটের এই রায় শুধু ব্রিটেন নয়, বিশ্বজুড়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রভাবশালী বহু দেশই চেয়েছে ব্রিটেন ইইউতে থেকে যাক। ইইউভুক্ত দেশগুলোও এটা চেয়েছে। তাদের সকলের চাওয়া ব্যর্থ করে দিয়েছে ব্রিটেনের জনগণ। ব্রিটেনের সংহতির ক্ষেত্রে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে, ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কি ধরনের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া ফেলবে এই গণরায়, তা এখনই বলা না গেলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নানা রকম আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। অনেকের অভিমত, ব্রিটেনের জাতীয় সংহতি বড় রকমে আহত হতে পারে। আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের জনগণ ইইউতে থেকে যাওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে। ইংল্যান্ডের জনগণ দিয়েছে বিপক্ষে। এ নিয়ে রাজ্যগুলোর মধ্যে বিভেদ প্রচ- হয়ে দেখা দিতে পারে। আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড স্বাধীনতার পক্ষে দাবি তুলতে পারে। ওদিকে লন্ডনের নাগরিকদের একাংশ লন্ডনকে স্বাধীন নগররাষ্ট্র ঘোষণা করে ইইউতে থেকে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়ার জন্য মেয়রের কাছে স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদনপত্র জমা দিয়েছে। এ থেকে মনে হচ্ছে ব্রিটেনের সংহতি রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। ওদিকে শুরুতেই মুদ্রামান ও শেয়ার বাজারে ধাক্কা লেগেছে। পাউন্ডের মূল্যমান ৩০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে এসে দাঁড়িয়েছে। শেয়ার বাজারেও ব্যাপক দরপতন হয়েছে। উল্লেখ্য, সারা বিশ্বেই শেয়ার বাজারে দরপতন হয়েছে ও তেলের মূল্য হ্রাস পেয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতীয় সংহতিতে চিড় ধরলে, অর্থনীতিতে ধস দেখা দিলে সমাজ-সংস্কৃতি-ঐহিত্য, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কসহ সকল ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিতে পারে। এ আশংকা যথেষ্ট প্রবল।
ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংহতির ওপরও হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। এ আশংকায় কিছুটা হলেও বিচলিত ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ। আর বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মধ্যে তারও বিচলিত, যারা সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী ইইউ প্রত্যাশা করেন। অনেকের ধারণা, ইইউ’র প্রভাবশালী এক বা একাধিক দেশ ব্রিটেনের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে ইইউ’র সংহতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, এর অস্তিত্বও হুমিকর মুখে পতিত হতে পারে। যে যাই বলুক, পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে ইইউ হলো একটি অনুসরণীয় মডেল। ইইউ’র দেখাদেখি বিশ্বে এ ধরনের বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্থা গড়ে উঠেছে। নিঃসন্দেহে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তিও। বিশ্বে তার প্রভাব বিস্তারকারী ক্ষমতার উৎস তার শক্তিশালী অর্থনীতিই। ব্রিটেন সরে আসার পর ইইউ’র বাকী দেশগুলো যদি সংহত হতে এবং প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম না হয়, তাহলে এই সংস্থার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এক সময় তেমন একটা থাকবে না। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আর্থ-রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিকসহ নানা ক্ষেত্রে যারা বিশেষভাবে সম্পর্কিত তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ব্রিটেনের গণভোটের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া গোটা বিশ্বে যেভাবে প্রতিফলিত হতে শুরু করেছে সেটা যে কোনো মূল্যায়নে বিচলিত হওয়ার মতো। ইইউ’র সক্ষমতার অভাব ও প্রভাব কমে যাওয়ার ফল নেতিবাচক হতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে নতুন বিন্যাস, অভিমুখ ও মেরুকরণ অনিবার্য। বাংলাদেশের সঙ্গে ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আর্থ-বাণিজ্য, বিনিয়োগ-ব্যবসা প্রভৃতি ক্ষেত্রে এ সম্পর্ক বিস্তৃত। উদ্ভূত পরিস্থিতি বাংলাদেশের লাভ হবে, না ক্ষতি হবে, হলে কোথায় কতটুকু হবে, সেটা এখনই খতিয়ে দেখা দরকার। পর্যবেক্ষকদের মতে, অনেক কিছুই নতুন করে গোছগাছ করতে হতে পারে, গুরুত্ব নির্ণয় করতে হতে পারে এবং উদ্যোগ-পদক্ষেপ জোরদার করতে হতে পারে। তাই বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে, আলোচনা-পর্যালোচনা করতে হবে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত ও কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন