বুধবার, ২২ মে ২০২৪, ০৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

আরবি ভাষা দিবস

কাজী সিকান্দার | প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস। আরব দেশসহ সারা বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেশ আড়ম্বরের সঙ্গেই এ দিবস পালন করে। বিশ্বের অনেক ভাষায় আরবি ভাষার প্রভাব রয়েছে। অন্যান্য ভাষার সাথে আমাদের বাংলা ভাষায়ও আরবি বিরাট একটি জায়গা করে নিয়েছে। আমরা নিত্যদিন পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অসংখ্য আরবি শব্দ ব্যবহার করি। তার সাথে আরবি আমাদের ধর্মীয় ভাষা। জান্নাতের ভাষা। রাসূলে আরবি সা. এর ভাষা। কুরআন ও হাদীসের ভাষা। তাই ইসলাম ও মুসলমানের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা আরবি। জাগতিক দিক থেকে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ আরবদেশে বসবাস করে জীবিকার প্রয়োজনে। তাই তাদের আরবি ভাষা শিখতে হয়। অপর দিকে একজন মানুষ আলেম হতে হলে আরবি ভাষা শিক্ষা করা অপরিহার্য। সবদিক থেকে আরবি ভাষা আমাদের জীবন চলার ক্ষেত্রে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

আরবি ভাষা আরব রাষ্ট্রসমূহ ছাড়াও অন্যান্য দেশে অতিগুরুত্বের সাথে চর্চা হয়। বিশেষ করে যে দেশে মুসলিম রয়েছে। এটা বহুল ব্যবহৃত একটি ভাষা। তবে আন্তর্জাতিকভাবে আরবি ভাষা অবহেলিত যেন। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা ছিল পাঁচটি। যথা: ইংরেজি, ফরাসি, চিনা, রাশিয়ান ও স্প্যনিশ। এখানে আরবদের নিজ মাতৃভাষা ব্যবহারের কোনো সুযোগ ছিল না। অন্য ভাষাতে তাঁদেরকে বক্তব্য প্রদান করতে হতো। এমনকি নথিপত্র আরবি থেকে কোনো দাপ্তরিক ভাষায় অনুবাদ করে উপস্থাপন করতে হতো। সৌদি আরব ও মরক্কো সরকার উদ্যোগী হয়। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৫৪ সালে ৪ ডিসেম্বর নবম অধিবেশনে ৮৭৮ নং প্রস্তাবে বছরে চার হাজার পৃষ্ঠা আরবিতে লিখিত অনুবাদ প্রকাশের বৈধতা প্রদান করে। সাথে শর্ত দিয়ে দেয় যে, অনুবাদের ব্যয়ভার সংশ্লিষ্ট দেশকে বহন করতে হবে। ১৯৬০ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ‘ইউনেস্কো’ আরব দেশগুলোতে আরবি ভাষায় সেমিনার ও জাতীয় সম্মেলন পরিচালনা এবং নথিপত্র ও প্রচারপত্র আরবিতে প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশগুলোতে অন্য ভাষা থেকে আরবিতে এবং আরবি থেকে অন্য ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর ১৯৬৮ সালে অনুবাদের সাথে সাথে আরবি ভাষাকে ইউনেস্কোর সাধারণ সভা ও কর্ম পরিষদের কার্যকরি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে সৌদি আরব ও মরক্কোর পাশাপাশি আরব বিশ্বের কূটনৈতিক চাপে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ২৮তম অধিবেশনে ৩১৯০ নং সিন্ধান্তে আরবিকে ষষ্ঠ দাপ্তরিক ভাষারূপে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ১৯০তম অধিবেশনে ১৮ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তখন থেকে ১৮ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস পালন করা হয়।

আন্তর্জাতিক ভাতৃভাষা দিবস ২১ ফেব্রæয়ারি। এ দিন বাংলাদেশের সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বার ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, যা ছিল বিশ্ব দরবারে একমাত্র ভাষার জন্য আত্মত্যাগ। বাংলাদেশিদের এ আত্মত্যাগকে বিশ্ব দরবার মূল্যায়ন করেছে এ দিবসকে আন্তর্জাতিক মতৃভাষা দিবস পালনের মাধ্যমে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান, ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনোস্কো ১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের প্রস্তাব জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ছটি ভাষার পৃথক পৃথক আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের ঘোষণা করা হয়। ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক ফরাসি ভাষা দিবস। ২০ এপ্রিল আন্তর্জাতিক চিনা ভাষা দিবস। ২৩ এপ্রিল আন্তর্জাতিক ইংরেজি ভাষা দিবস। ৬ জুন আন্তর্জাতিক রুশ ভাষা দিবস। ২১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক স্প্যানিশ ভাষা দিবস।

আরবি ভাষার সাথে এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের আত্মার সম্পর্ক রয়েছে। এ দেশের জনসাধরণ আরবি ভাষাকে পরম শ্রদ্ধা করে। মনে থেকে ভক্তি করে। হৃদয় দিয়ে ভালবাসে। আরবি ভাষার যেমন রয়েছে ধর্মীয় গুরুত্ব, তেমনি রয়েছে বৈষয়িক গুরুত্ব। পৃথিবীর প্রায় ২৮ কোটি জনগোষ্ঠির মাতৃভাষা আরবি। ২৫ কোটি মানুষ আরবিকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে। ২৫টি দেশের দাপ্তরিক ভাষা আরবি। অপর দিকে অর্থনৈতিক বিবেচনায় আরবি ভাষা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরত্ব রাখে। দেশের অর্থনীতির অন্যতম শক্তি ধরা হয় রেমিটেন্স। আর এ রেমিটেন্সের সিংহভাগই অর্জিত হয় আরবি ভাষার দেশসমূহ থেকে। এদেশের জনগণ যখন আরব দেশে যায়, তখন তারা ভাষা না জানায় বেশ বিড়ম্বনায় পড়ে। তারা যদি ভালভাবে আরবি ভাষা জানতো তবে লোকগুলো আরবদেশে নিজেদের অবস্থান আরও মজবুত করতে পারতো। তাদের ন্যায্য সুযোগ সুবিধা আরো বেশি আদায় করে নিতে পারতো। তাই বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে আরো চাঙ্গা করার লক্ষ্যে হলেও আরবি ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্ব দেয়া দরকার। বাংলাদেশের মূলধারার মিডিয়ায় আরবি ভাষা দিবসটির কোনো গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয় না। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তো আরবি ভাষা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ইসলামের যে কোনো বিধান জানতে হলে আরবি ভাষা জানতে হবে। কুরআন ও হাদীসের সঠিক মর্ম বের করতে হলেও আরবি ভাষা অবশ্যই প্রয়োজন। আরবি ভাষা অধ্যয়ন বা আয়ত্ত করা ছাড়া কোনো লোক ইসলামের কোনো বিষয়ের উপর ফতোয়া দিতে পারে না। তাফসীর বা কুরআনের ব্যাখ্যা অন্যকে শিখাতে হলে, বিধানাবলি বলতে হলে অবশ্যই আরবি ভাষা জানতে হবে।
লেখক: পরিচালক, ইসলাহ বাংলাদেশ, কামরাঙ্গীরচর, ঢাকা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন