অর্থনৈতিক রিপোর্টার : বেনারসী, কাতান কিংবা জামদানি। যে নামেই হোক না কেন, বাঙালী রমণীদের কাছে শাড়ী জগতে সমাদৃত একটি বিশেষ নাম। আর সেটি যদি হয় মিরপুরের বেনারসী পল্লীতে তৈরি, তাহলে তো কথাই নেই। ঈদ উপলক্ষে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে রাজধানীর মিরপুরের ঐতিহ্যবাহী বেনারসী পল্লীতে। খুচরা ক্রেতা এবং পাইকারদের আনাগোনায় মুখর হয়ে উঠেছে এই পল্লীর প্রতিটি ইন্ডাস্ট্রি। দিন-রাত একটানা কাজ চলছে প্রতিটি কারখানায়। শো-রুমগুলোতে রয়েছে ক্রেতাদের ভিড়। ঈদ উপলক্ষে নানান রং এবং নকশার শাড়ী, ওড়না উঠানো হয়েছে প্রতিটি শোরুমে। সাধারণ বুটি কাতান থেকে শুরু করে ৪৫-৫০ হাজার টাকা মূল্যের জর্জেট কাতানও তোলা হয়েছে বেশ কিছু শোরুমে। এছাড়াও রয়েছে প্রায় ২ লাখ টাকা দামের বিভিন্ন ধরনের বেনারশি গোল্ড শাড়ী।
গতকাল মিরপুর পল্লবীর এই বেনারসী পল্লীতে ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি দোকানে একই চিত্র। বুটিক, স্টোন, জরির বাহারি কাজের দেশীয় বস্ত্রের বিপুল সমারোহ ঘটানো হয়েছে পল্লীতে। ঈদ উপলক্ষে সব শ্রেণীর ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে প্রতিটি কারখানাতে বিভিন্ন দামের শাড়ী প্রস্তুত করা হচ্ছে। বিক্রেতারা জানান, ঈদে কাতান জাতীয় শাড়ীর চাহিদা বেশী। তাদের মতে, প্রায় ৩শ’ ধরনের পণ্য আছে তাদের দোকানে। দাম ১৫শ’ থেকে প্রায় ১ লাখ টাকা। তবে, ক্রেতাদেরকে দেশীয় পণ্যের সঙ্গে ইন্ডিয়ান পণ্যের পার্থক্য বুঝাতে কিছু ইন্ডিয়ান শাড়ীও রাখা আছে দোকানে বলে জানান তারা।
বেনারসী পল্লী ঘুরে দেখা যায়, এখানে তৈরি হয় ফুলকলি কাতান, দুলহান কাতান, মিরপুরী রেশমি কাতান, মিলেনিয়াম কাতান, বেনারসী কসমস, অরগন্ডি কাতান, ব্রকেট কাতান, রেশমি কাতান, প্রিন্স কাতান, রিমঝিম কাতান, টিস্যু কাতান, মিরপুরী গিনি গোল্ড কাতান, জর্জেট গিনি গোল্ড কাতান, চুনরি কাতানের মতো শাড়ি। একই ধরনের কাপড় রয়েছে রানা সিল্ক প্লাজা, আরিফ বেনারসী কুঠির, রোখসানা জরি সিল্ক ইন্ডাস্ট্রি, তানিয়া বেনারসী কর্ণার, রিভার সিল্ক ইন্ডাস্ট্রি, খুরশীদ সিল্ক, নাহিদ আক্তার সিল্ক ইন্ডাস্ট্রি, আমানত সিল্ক ইন্ডাস্ট্রিতে। ঈদ সামনে রেখে মিরপুর ২, ৩ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড এবং সেকশন ১০, ১১, ১২ ও ১৩-এর বেনারসী পল্লীর ৩০০টিরও বেশি দোকানে ক্রেতারা আসছেন। পল্লীর অধিকাংশ ব্যবসায়ী জানান, হিন্দি সংস্কৃতির আগ্রাসনে দেশী শাড়ির বাজারে ধস নেমেছে। তাই এ থেকে উত্তরণে সরকারের কাছে জরুরী পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানান তারা। কুমিল্লার চান্দিনা থেকে হানিফ সিল্কে শাড়ী কিনতে এসেছেন মো. সেলিম হোসেন। এখানে ভালো মানের শাড়ী পাওয়া যায় জেনে এসেছি বলে জানান তিনি। শাড়ী কিনতে আসা মিরপুরের ১৩ নম্বরের বাসিন্দা নাজমা ইসলাম ও মেয়ে তানিজ মজুমদার জানান, প্রতিবছর ঈদ বা অন্যান্য অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে এখান থেকেই শাড়ী কিনেন। অন্যান্য স্থানের চেয়ে এখানকার শাড়ীর মানও ভাল, দামও কিছুটা কম। একই কথা জানালেন আরেক ক্রেতা মো. মোখলেছুর রহমান। বেনারসী তাঁতী সমিতির সভাপতি ও হানিফ সিল্ক ইন্ডাস্ট্রিজ-এর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হানিফ ইনকিলাবকে বলেন, হুমকির মধ্যে রয়েছে দেশের তাঁত শিল্প। এই সেক্টরে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে। বিদেশী নিম্নমানের পোশাকে সয়লাব হয়ে গেছে বাজার। পার্শ্ববর্তী দেশের নিম্নমানের পোশাকের বাজার সৃষ্টি করার লক্ষ্যে একটি মহল দেশীয় তাঁত শিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। তিনি জানান, কয়েক বছর আগেও ঐতিহ্যবাহী মিরপুর বেনারসী পল্লীতে ১৩ হাজার কারখানায় লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করত। এখন মিরপুর ২,৩ ও ৫ নং ওয়ার্ডে মাত্র ৩-৪ হাজার তাঁত রয়েছে। যাতে ১০-১২ হাজার দক্ষ শ্রমিক কাজ করে। তাঁত শিল্পকে বিশ্ববাজারে আগের সেই অবস্থানে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকারের এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার বলে মনে করেন তিনি। এজন্য তিনি সরকারের কাছে দাবি জানান, তাঁত বস্ত্রজাত পণ্যের আমদানী নিষিদ্ধ করার।
মোহাম্মদ হানিফ জানান, ঈদে তাঁত বস্ত্রের বিপুল চাহিদা থাকে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই সেক্টরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে অনেক কারখানা মালিক পুঁজির সংকটে ভুগছে। রাজধানীসহ সারাদেশের অভিজাত মার্কেট এবং সাধারণ মার্কেটগুলোতে দেশীয় বস্ত্রের বিপুল চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে ঈদ উপলক্ষে বেনারসী পল্লীতে কিছুটা প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসলেও আগের সেই জাঁকজমকপূর্ণ অবস্থা নেই বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, রাজধানী ও আশে পাশে আয়োজিত বেশ কিছু মেলায় দেশীয় বস্ত্র বা তাঁত মেলার নামে বিদেশী পোশাকের সম্ভার ঘটিয়ে প্রকৃত অর্থে তাঁত শিল্পের ক্ষতি করা হচ্ছে।
এ বছরের ঈদ বাজার সম্পর্কে তিনি বলেন, ভালো তবে আগের মতো নয়। তার শো-রুমে ৫০/৬০ হাজার টাকা দামের লেহেঙ্গা ও থ্রী পিছ রয়েছে। এখানে লাভ বেশি করা হয় না। অধিকাংশই পাইকারি বিক্রি করা হয়। বাইরের দোকানে এর দাম অনেক বলে জানান তিনি। চাঁদ রাত পর্যন্ত বিক্রি চলবে বলে উল্লেখ করেন মোহাম্মদ হানিফ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন