শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ভূমির অধিকার নিয়ে ফের উত্তপ্ত হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম

সৈয়দ ইবনে রহমত | প্রকাশের সময় : ২২ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

গত ২৭ নভেম্বর রাঙ্গামাটি সার্কিট হাউজে এক বৈঠক শেষে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক জানান, আগামী ২৩ ডিসেম্বর থেকে কমিশনের শুনানি করা হবে। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহত্তর জনগোষ্ঠি বাঙালিদের উপজাতীয় প্রাধান্যবিশিষ্ট ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন এবং কমিশন আইনের উপর আস্থা রাখার মতো কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট ভূমি কমিশনে পার্বত্য বাঙালিদের কোনো প্রতিনিধি নেই। চেয়ারম্যান সুপ্রিমকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। এছাড়া সদস্য হিসেবে আছেন আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান (উপজাতীয় এবং অনির্বাচিত), সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান (উপজাতীয় এবং অনির্বাচিত), সংশ্লিষ্ট সার্কেল চিফ (উপজাতীয় এবং অনির্বাচিত) এবং চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার বা তার প্রতিনিধি (সরকারের প্রতিনিধি, যিনি বাঙালি বা উপজাতীয় যে কেউ হতে পারেন)। কমিশনের সচিব এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকাংশই উপজাতীয়দের মধ্য থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ লাভের অধিকারী। কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, যিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করা বাঙালিদের ভূমির অধিকারে বিশ্বাস করেন না, বরং সমতলের অন্য কোথাও সরিয়ে নিয়ে তাদের পুনর্বাসনের দাবিতে জোরালো আন্দোলন করে যাচ্ছেন। ভূমি কমিশনে তার কাছ থেকে নিরপেক্ষ ভূমিকা আশা করা যায় না। অপরদিকে সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং সার্কেল চিফ আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যানের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবেন বা করবেন তার কোনো নিশ্চয়তাও নেই। প্রথাগত আইন, রীতি ও পদ্ধতির দোহাই দিয়ে আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং সার্কেল চিফ যে সিদ্ধান্ত দেবেন তা কোনোভাবেই খন্ডানোর সুযোগ কমিশনের চেয়ারম্যান এবং সরকারের প্রতিনিধির থাকবে এমন নিশ্চয়তা নেই। এত কিছুর পরও আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যানের দাবি মেনে ২০০১ সালের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের সংশোধন করে বাঙালিদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার পথকে আরো সঙ্কীর্ণ করে ফেলা হয়েছে। তাই নিজেদের ভূমির অধিকার হারানোর ভয় পার্বত্য বাঙালিদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সে কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিরা নতুন করে তাদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার আন্দোলনে নেমেছে। নানা বিষয়ে ভিন্ন মত থাকলেও বাঙালিদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো ইতোমধ্যে ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। ফলে যেকোন সময় পার্বত্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। 

পার্বত্য চট্টগ্রামে সবচেয়ে জটিল সমস্যা হচ্ছে ভূমি বিরোধ। আর এ সমস্যাটি বাঙালিদের কাছে জটিলতর হয়ে উঠেছে মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি তথা সন্তু লারমার চাহিদা মতো ‘পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১’ সংশোধনের কারণে। ২০১৬ সালেল ১ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনের ১৪টি সংশোধনী অনুমোদন করার এক সপ্তাহ পর ৮ আগস্ট রাষ্ট্রপতি কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সংশোধিত আইনে ভূমি কমিশনের নিয়ন্ত্রণ চলে যেতে পারে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের হাতে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালিদের ভূমিহীন করার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেয়ে যাবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির সভাপতি। আর কমিশনকে ব্যবহার করে তিনি কোনো বাঙালি পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে উচ্ছেদ করলেও কোনো আইন-আদালতে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ থাকবে না। কেননা, ভূমি কমিশন আইনের ১৬ নং অনুচ্ছেদেই বলা আছে যে, ‘ধারা ৬(১)-এ বর্ণিত কোন বিষয়ে দাখিলকৃত আবেদনের উপর কমিশন প্রদত্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ানী আদালতের ডিক্রী বলিয়া গণ্য হইবে, তবে উক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন আদালত বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষের নিকট আপীল বা রিভিশন দায়ের বা উহার বৈধতা বা যথার্থতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’
গত ১ আগস্ট ২০১৬ সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০১৬’ চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়। বৈঠক শেষে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের সংবাদ ব্রিফিং এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সূত্রের বরাত দিয়ে পরদিন ২ আগস্ট জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, পার্বত্য ভূমি কমিশন আইনের ১৪টি সংশোধনীর অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। আর সংসদ যেহেতু দুই মাস পরে বসবে, তাই জরুরি বিবেচনায় এটাকে অধ্যাদেশ আকারে জারির সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার পর থেকেই আন্দোলনে উত্তাল হতে শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রাম। ভূমি কমিশন আইন সংশোধনের ফলে পার্বত্য বাঙালিদের উদ্বেগের মূল কারণটি স্পষ্ট হয়েছে এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক বলেন, ‘১৯৮৭ সালে পার্বত্যাঞ্চলের এসব দেশদ্রোহীরা সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছিলো পুরো বাংলাদেশ দু’টি ভাগে ভাগ করার। এক ভাগের নাম বাংলাদেশ, যার রাজধানী ঢাকা। আর এক ভাগের নাম হবে জুম্মল্যান্ড, যার রাজধানী রাঙাগামাটি। এই দু’টি অংশ মিলে একটি ফেডারেল সরকার হবে। তখন আমরা রাজি হইনি। কিন্তু বর্তমান এই ভূমি আইন বাস্তবায়নের ফলে দেশদ্রোহীদের সেই সপ্ন বাস্তবায়ন হবে।’
ভ‚মি কমিশন: ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত চুক্তিতে ভূমিবিরোধ সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য একটি ল্যান্ড কমিশন গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ‘ঘ’ খন্ডের ৪, ৫ ও ৬ ধারা মতে, ৩ জুন ১৯৯৯ ল্যান্ড কমিশন গঠন করে। এরপর সরকার ২০০১ সালের ৫৩ নং আইন তথা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১’ পাস করে। এই আইনটিতেই পার্বত্য বাঙালিদের ভূমির অধিকার খর্ব করার যাবতীয় ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু এতে সন্তু লারমার একক কর্তৃত্ব করার সুযোগ কিছুটা কম থাকায় তিনি নাখোশ হন। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি আঞ্চলিক পরিষদের মাধ্যমে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১-এর ব্যাপারে আপত্তি তুলে সংশোধনের দাবি জানান। তারা সরকারের পাসকৃত আইনের ২০টি ধারার বিপরীতে আঞ্চলিক পরিষদের মাধ্যমে প্রথমে ১৯ দফা সুপারিশ প্রেরণ করেন। পরবর্তী সময়ে সুপারিশ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩-এ। আঞ্চলিক পরিষদের সুপারিশসমূহকে উদ্দেশ্য অনুসারে আমরা দুই ভাগে বিভক্ত করতে পারি। প্রথমত, এমন কিছু সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে এগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভূমির উপর পার্বত্য বাঙালিদের অধিকারকে খর্ব করে উপজাতীয়দের স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। দ্বিতীয়ত, অবশিষ্ট সুপারিশগুলো করা হয়েছে, যাতে ভূমি কমিশনের ওপর থেকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে আঞ্চলিক পরিষদ তথা জেএসএসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে যে ১৪টি সংশোধনী গ্রহণ করেছে তাতে জেএসএসের উভয়বিদ সিদ্ধান্তই হাসিল হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সভায় বারবার ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনী: ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১’ পাসের পর থেকে সরকারের নানা পর্যায়ে এ আইন সংশোধন নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। একাধিকবার মন্ত্রিপরিষদ সভাতেও আইনটির সংশোধনী উত্থাপিত হয়েছে, এমনকি উত্থাপিত সংশোধনী পাসের অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। গত ৩০ জুলাই ২০১২ মন্ত্রিপরিষদ সভা ভূমি কমিশন আইনের ১৩টি সংশোধনী পাসের জন্য অনুমোদন দিয়েছিল, কিন্তু তা কার্যকর করা যায়নি। এরপর ২০১৩ সালের ২৭ মে মন্ত্রিপরিষদ সভা ভূমি কমিশন আইনে আগের গৃহীত ১৩টি থেকে কমিয়ে ৬টি সংশোধনী গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়, যা সংসদের মাধ্যমে পাস করার কথা ছিল। কিন্তু সেটিও শেষ পর্যন্ত কার্যকর করা যায়নি। এরপর বেশকিছু দিন নীরব থেকে হঠাৎ করেই ২০১৬ সালে ১৪টি সংশোধনী অনুমোদন করেছে মন্ত্রিপরিষদ। আর সংসদ বসতে দুই মাস বিলম্ব থাকায় তখন তড়িঘড়ি করে তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস, সংবিধান ও সার্বভৌমত্বের বিবেচনা: গত ৮ মে ২০১৬ রাজধানীর বেইলী রোডে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স নির্মাণের ভিত্তিফলক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১’ সংশোধনের আশ্বাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘২০০১ সালে আমরা যে আইনটা করেছিলাম, সেখানে তারা (পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি তথা সন্তু লারমা) কিছু সংশোধন চেয়েছেন। সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে যতটুকু করা সম্ভব, সেটা আমরা করে দেব।’ প্রধানমন্ত্রীর সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে আইন সংশোধনের সেই আশ্বাস ১ আগস্ট ২০১৬ তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদ সভায় কতটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হওয়া অমূলক হবে না। কারণ, এর আগে মন্ত্রিপরিষদ সভায় প্রথম দফায় ১৩টি এবং পরে ৬টি সংশোধনী গৃহীত হওয়ার পরেও সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নেই তা কার্যকর করা যায়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে যে, আগে যেসব সংশোধনী দেশের সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে কার্যকর করা যায়নি, কোন বিবেচনায় সেসব সংশোধনী সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে মান উতীর্ণ হয়ে গেল? তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেও যার বা যাদের পরামর্শে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১’ সংশোধন করা হয়েছে, তারা সংবিধান ও সার্বভৌমত্বের প্রতি কতটা অনুগত তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে। ১৯৯৮ সালের ৬ ডিসেম্বর পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ গঠনের পর ১৯৯৯ সালের ১২ মে সন্তু লারমা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ করেন। সেই থেকে অদ্যাবধি একই পদে তিনি বহাল আছেন। রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করছেন। অথচ আজ পর্যন্ত তিনি কোনো দিন এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনারে গিয়েছেন বলে শোনা যায় না। তাছাড়া, সন্তু লারমার দল পার্বত্য জনসংহতি সমিতি সংসদ নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নিয়মিতই অংশ নেয় এবং তাতে জয় লাভও করে। অথচ দলটির প্রধান সন্তু লারমা আজ পর্যন্ত এদেশের নাগরিকত্বের প্রতীক জাতীয় পরিচয়পত্রটি পর্যন্ত গ্রহণ করতে সম্মত হননি। সেই তারই পরামর্শে ‘পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১’ সংশোধন করার পরিণতি কী হতে পারে তা অনুমান করে দেশবাসীর মনে উদ্বেগ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হওয়াটা কি অমূলক?
বাঙালিদের ভূমি এবং ভোটাধিকার হরণ: পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের ৪নং ধারার ২নং উপধারায় বলা হয়েছে, ‘চেয়ারম্যান ও অন্যান্য সদস্যগণ জনসাধারণ কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে এই আইন ও বিধি অনুযায়ী নির্বাচিত হইবেন।’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ভোটার তালিকা প্রয়োজন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে সুষ্ঠু ভোটার তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে যাতে জটিলতা সৃষ্টি করা যায়, সম্ভবত সেই উদ্দেশ্যই পার্বত্য চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ৯নং ধারার ৪নং উপ-ধারায় কোনো ব্যক্তির ভোটার হওয়ার ব্যাপারে একটি বিতর্কিত এবং সংবিধান পরিপন্থী শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ওই উপধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি তিনি পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হন’, যা পরে ১৯৯৮ সালে জেলা পরিষদ আইনসমূহ সংশোধন করে ১৭নং ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আবার অ-উপজাতীয়দের ক্ষেত্রে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার শর্ত জুড়ে দিয়ে পার্বত্য চুক্তির ‘খ’ খন্ডের ৩নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘অ-উপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দা বলিতে- যিনি উপজাতীয় নহেন এবং যাহার পার্বত্য জেলায় বৈধ জায়গা জমি আছে এবং যিনি পার্বত্য জেলায় সুনির্দিষ্ট ঠিকানায় সাধারণত বসবাস করেন তাহাকে বুঝাইবে।’
অর্থাৎ পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে ভোটার হতে হলে বৈধ জমির মালিক হতে হবে। কিন্তু বাঙালিরা যাতে বৈধ জায়গা সম্পত্তির মালিক হতে না পারে সে জন্যও সকল পদক্ষেপ নিয়ে রাখা হয়েছে। যেমন- খাস জমি বন্দোবস্ত প্রদান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিক্রয় বা অন্যান্যভাবে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে জেলা পরিষদকে অবহিত করে বা জেলা পরিষদের অনুমতি নেয়াকে শর্ত করে দেয়ায় বাঙালিদের ভূমির মালিক হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। উপরন্তু ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনকে সংশোধন করে মূলত আঞ্চলিক পরিষদের হাতকেই শক্তিশালী করা হয়েছে।
আসলে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের উদ্দেশ্য সরকারে নিকট যাই থাকুক উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে এর উদ্দেশ্য পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের ভূমিহীন করা। কেননা পার্বত্য বাঙালিদের বড় একটি অংশকে ভূমিহীন করতে পারলে সংবিধান পরিপন্থীভাবে (পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের ক্ষমতা বলে) তাদের ভোটাধিকার হরণ করা যাবে। আর সেটা সম্ভব হলে বাঙালিরা পার্বত্যাঞ্চলে ভূমির অধিকার, ভোটাধিকার হারিয়ে এক সময় হতাশ হতে বাধ্য হবে। আর মৌলিক অধিকার বঞ্চিত এসব মানুষ হয়তো পার্বত্যাঞ্চল ছেড়ে যেতে শুরু করবে। এর পরিণতিটা কী হবে সহজেই অনুমেয়।
ভূমি কমিশন আইন সংশোধন, আদিবাসী স্বীকৃতি আদায়, জেলা পরিষদের মাধ্যমে পুলিশের উপর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের প্রচেষ্টাসহ পার্বত্যাঞ্চলের উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ প্রতিটি পদেক্ষেপই নিচ্ছে সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই। ভূমিকমিশন আইন সংশোধনীর প্রতিটি প্রস্তাবই তাদের সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্যই আনা হয়েছে। এখন সংশ্লিষ্টরা যদি এসব বুঝতে অপারগ হয়, তাহলে এর দায় শুধু তাদের ওপর বর্তাবে না, বরং দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের ওপরও বর্তাবে। অতএব, সময় থাকতেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির নামে কোনো মহল যেন বাঙালিদের ভূমিহীন করার সুযোগ পেয়ে না যায় সে ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে; সিদ্ধান্ত নিতে হবে ন্যায় ও সংবিধানের অনুকূলে।

লেখক : পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক
sayedibnrahmat@gamil.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Jakir ২২ ডিসেম্বর, ২০১৯, ৩:৪৬ এএম says : 0
May Allah bless you and mercy you with then best of His for this alert and carefulness deeds. We should prevent all offensive against humanity and hate all nationality which goes against human beings.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন