গত দু’দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে নতুন ট্রেন সোনার বাংলা এক্সপ্রেস এবং মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছেন। সোনার বাংলা এক্সপ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি অনেক আশার কথা শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সেদিন বেশি দূরে নয় ইনশাআল্লাহ আমরা বাংলাদেশে উচ্চগতির বুলেট ট্রেন ও পাতাল রেল চালু করতে পারব। পাতাল রেলের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেছেন, দুর্গম এলাকাসহ দেশের সবক’টি জেলাতেই রেলের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, তার সরকারের মেয়াদে ৯৮টি নতুন ট্রেন সংযুক্ত হয়েছে এবং ২৬টি যাত্রী সেবার পরিধি বাড়ানো হয়েছে। ২০টি নতুন মিটারগেজ এবং ২৬টি ব্রডগেজ লোকোমোটিভ, ১২০টি যাত্রীবাহী কোচ, ১৬৫টি ব্রডগেজ এবং ৮১টি মিটারগেজ ট্যাংক ওয়াগন, ২৭০ মিটারগেজ ফ্লাট ওয়াগন, ২০ সেট মিটারগেজ ডেমু ট্রেন প্রভৃতি রেলের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। বহু প্রত্যাশিত মেট্রোরেল ও বাস র্যাপিড ট্রানজিটের প্রস্তাবনা অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে ২০১৯ সালের মধ্যে উত্তরা তৃতীয় পর্যায় থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেলের বাণিজ্যিক চলাচল শুরু হবে। ২০২০ সালে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের সম্পূর্ণ অংশের নির্মাণ কাজ শেষ হবে। বলা হয়েছে, মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত আসতে সময় লাগবে ৩৮ মিনিট। মেট্রোরেলের প্রকল্পটি ৮টি প্যাকেজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলের গুণাগুণ নতুন করে উল্লেখের প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতাতেও রেলপথকে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি বলে উল্লেখ করেছেন। শুধু বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও সড়ক পথে দ্রুততম ও নিরাপদ যোগাযোগের জন্য রেলকেই বেছে নেয়া হচ্ছে। ইউরোপীয় দেশগুলোকে রেল একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে যুক্ত করছে। সাগরের নীচ দিয়ে, পাহাড় কেটে রেলের যাত্রা নিশ্চিত করার সকল ও সফল উদ্যোগ চলছে। পৃথিবীব্যাপী যখন রেলের দ্রুত উন্নয়ন ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে, তখন আমাদের রেল সেই মান্ধাতার আমলেই রয়ে গেছে। সরকারী যত পকিল্পনার কথাই শোনা যাক না কেন বাস্তবতা হচ্ছে যাত্রীসেবার মান বাড়েনি। সিডিউল বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। ট্রেনের টিকিট প্রাপ্তিকে সহজ করার নামে এ যাবৎকাল যা কিছু করা হয়েছে তাতে সাধারণ যাত্রীদের কোন উপকার হয়েছে তা বলা যাবে না। নানা ছলছুঁতায় বিশেষ আসনগুলো কোটাভুক্তদের দখলেই থেকে যাচ্ছে। কোটা ব্যবস্থার ফলে সাধারণের পক্ষে সীট পাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব অনিয়ম অভিযোগ-এর প্রতিকারের কোন কার্যকর উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এর বাইরে রেল নিয়ে নানা দুর্নীতি তো রয়েছেই। নিয়োগ থেকে শুরু করে কেনাকাটা সর্বত্রই দুর্নীতির ছাপ স্পষ্ট। রেলের পণ্য কেনায় বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে বলে সম্প্রতি অডিট আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল। গত এপ্রিলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্নমুখী অনিয়মের মাধ্যমে রেলে আর্থিক অনিয়ম হয়েছে প্রায় ৮শ’ কোটি টাকা। সিএজির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেল বিভাগে প্রচলিত সরকারি বিধি-বিধান ও নির্দেশ অনুসরণ করা হয়নি। যথাসময়ে দরপত্র আহ্বান ও চুক্তি করা হয়নি। রেলের অনিয়ম এখানেই শেষ নয়। সারাদেশে অনেক জায়গায় রেলের ক্রসিং-এ গেইট বা গেইটম্যান না থাকায় বহু দুর্ঘটনা ঘটছে এবং এতে বহু মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এক ধরনের অবহেলা, অদক্ষতা অপরিপক্বতাই যেন রেলকে পেয়ে বসেছে। এটি সত্যি দুর্ভাগ্যজনক ও অনভিপ্রেত।
উন্নয়ন একটি ধারাবাহিকতার অংশ। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন তাদের প্রচলিত কাজের অংশ হচ্ছে উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা। দিনদিন যেভাবে মানুষ ও কর্মব্যস্ততা বাড়ছে তাতে যোগাযোগ খাতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার মানেই উন্নয়নকে অস্বীকার করা। কেবলমাত্র যানজটের কারণে খোদ রাজধানীতে এখন শত শত কর্মঘণ্টার অপচয় হচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে। এখন আর বিষয়টি কেবল রাজধানীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সর্বত্র। শত চেষ্টা সত্ত্বেও সড়ক ব্যবস্থাপনার কোন উন্নতি করা গেছে তা বলার কোন উপায় নেই। সে বিবেচনায় যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে সেগুলো যখন বাস্তবায়িত হবে তা থেকে সাধারণের উপকৃত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে যদি সেবারমান ঠিক না থাকে তাহলে এসব প্রকল্প করা আর না করার মধ্যে কার্যত কোন পার্থক্য থাকবে না। নতুন রেল সংযোজন অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। তবে এরকম একটি দুটি সংযোজন দিয়ে রেলের উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধার যে অপ্রতুলতা রয়েছে, তার উন্নয়ন যদি না করা যায়, তবে রেলের উন্নয়ন বা সেবারমান বৃদ্ধিÑ কোনোটাই করা যাবে না। কাজেই বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধার দিকে আগে মনোযোগ দিতে হবে। রেলের গ্রাসরুট লেবেল থেকে এর উন্নয়ন-আধুনিকায়নের কাজ শুরু করতে হবে। তা নাহলে যতই বড় বড় প্রকল্প নেয়া হোক না কেন, কোনোটিই যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হবে না। আমরা মনে করি, রেলের উন্নয়ন ধারাবাহিকভাবে করতে হবে। এটি একটি অবিরাম প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে রেলকে দুর্নীতিমুক্ত ও নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যে আসতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন