মাদকের সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের শিকার দেশের যুব সমাজ। একটি দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ সে দেশের যুব সমাজ। যুব সমাজ যদি মাদকে আসক্ত হয়, নানা অবক্ষয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে- তবে সে দেশের উন্নয়ন-সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত হতে পারে না। জাতির ভবিষ্যত সমস্যাসংকুল ও অনিশ্চিত হতে বাধ্য। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, দেশের যুব সমাজের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। বলা হয়ে থাকে, মাদকাসক্তদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল ৬৫ শতাংশের মতো। পত্র-পত্রিকায় এমন বহু খবর ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে যাতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, শিশু-কিশোর, মহিলা এবং এমনকি বিভিন্ন পেশাজীবীর মধ্যেও মাদকাসক্তি বিস্তার লাভ করছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বা এই পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদকের আসক্তি ব্যাপক আকার নিয়েছে। এ রকম খবর আছে, মাদক ব্যবসায়ীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের বিশেষ টার্গেটে পরিণত করেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদক বিক্রীই নয়, মাদক পরিবহন ও বিপণনের কাজেও তারা তাদের ব্যবহার করছে। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় এটি করা হচ্ছে। মাদকের অবাধ বিস্তার এবং শিক্ষার্র্থীদের মধ্যে আসক্তির সংখ্যা বাড়ার প্রেক্ষিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার কমছে, লেখাপড়ার প্রতি তাদের আগ্রহ কমছে, শিক্ষার মান হ্রাস পাচ্ছে এবং শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশের অবনতি ঘটছে। এই প্রেক্ষাপটে একদা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাদক বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যে কমিটির কাজ নির্ধারণ হয়েছিল, মাদকের ক্ষতিকর দিক ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা। ২০০৯ সালে এ উদ্যোগ নেয়া হয়। এ পর্যন্ত ৩২ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২১ হাজারে এই কমিটি হয়েছে। কমিটিগুলো কার্যত অকেজো। তাদের তেমন কোনো কাজ করতে দেখা যায় না। গত ১৯ মে রাজধানীতে সরকারী স্কুলের প্রধানদের যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতে তারা মাদককেন্দ্রিক নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেন।
এ কথা তিক্ত হলেও সত্য, সহজ প্রাপ্যতা মাদকের বিস্তার ও আসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণ। সাগর ও সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট হয়ে মাদক সামগ্রী দেশে অনুপ্রবেশ করছে। ইয়াবা-ফেন্সিডিল থেকে শুরু করে এমন কোনো মাদক নেই যা দেশে ঢুকছে না। সীমান্ত পথে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই তা ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন স্থানে। আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানী চক্র বাংলাদেশকে ট্রানজিট কান্ট্রি হিসেবে ব্যবহার করছে অনেক দিন ধরে। এই চক্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। চোরাচালান হয়ে আসা মাদকের অংশ বিশেষ অন্য দেশে চলে যাচ্ছে আর অংশ বিশেষ এখানেই বাজারজাত হচ্ছে। মাদক দ্রব্যের অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে যেমন শক্তিশালী কোনো ব্যবস্থা নেই, তেমনি এর চলাচল, ব্যবসা, কেনাবেচা ও সেবন বন্ধেও কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে মাদকের আগমন, আগ্রাসন ও ক্ষতি কেবল অব্যাহতই থাকছে না দিনকে দিন বাড়ছে। মাদকাসক্তি অভিশাপ হিসাবে গণ্য। যে একবার কোনো মাদকে আসক্ত হয়েছে, তার পক্ষে সুস্থ থাকা ও স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করা অসম্ভব। মাদক সুস্থ মানুষের দেহকেই ধ্বংস করে দেয় না, তারা অন্য সব কিছুকেও ধ্বংস করে দেয়। মানুষ হিসেবে তার গুণ, বৈশিষ্ট্য ও মূল্যবোধ ধ্বংস করে তাকে পশুর স্তরে নামিয়ে দেয়। মাদক একই সঙ্গে স্বাস্থ্য, উৎপাদন, অপরাধ, নিরাপত্তা ইত্যাদির সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা প্রতিপন্ন করে। স্বাস্থ্যের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করে। উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে। অপরাধ সংগঠনে প্ররোচক ভূমিকা পালন করে। জননিরাপত্তার যে সংকট আমরা প্রত্যক্ষ করছি তার মূলে মাদকের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। খুন, ছিনতাই, রাহাজানি, অপহরণ ধর্ষণ ইত্যাদি মারাত্মক অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বড় অংশটিই বিভিন্ন মাদকে আসক্তে।
আমাদের যুব সমাজকে যদি আমরা সুরক্ষা করতে চাই, অন্যায়-অপরাধ কমাতে চাই, সমাজকে নিরাপদ ও বাসযোগ্য রাখতে চাই এবং দেশের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে চাই, তবে মাদকের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াই ও বিজয় অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। দেশ ও সমাজকে মাদক মুক্ত করতে হলে মাদকের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হবে, মাদকের চলাচল বিপণন ও বিক্রি বন্ধ করতে হবে। মাদক চোরাচালান ও ব্যবসার নেটওয়ার্ক গুঁড়িয়ে দিতে হবে এবং মাদক চোরাচালান ও ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে বলা আবশ্যক, মাদকের আগ্রাসন ও অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য শুধু প্রশাসনিক ও আইনী ব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়, সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলাও জরুরী। সামাজিক প্রতিরোধের জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিই পূর্বশর্ত। মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক, সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে হবে। সব বয়স ও শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে যদি মাদকের ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা যায় এবং তাদের মধ্যে সচেতনতা আসে তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মাদকাসক্তের সংখ্যা কমবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, আলেম-ওলামা ও সমাজের সচেতন মানুষ নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে পারে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদক বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধির যে কর্মসূচী নেয়া হয়েছিল তা জোরদার করতে হবে কমিটি গঠন ও কার্যকর করার মাধ্যমে। এ কর্মসূচী ও কমিটি অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সম্প্রসারিত করতে হবে। উল্লেখ করা দরকার, মাদরাসা ও তার শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণ মাদকসংশ্রবমুক্ত। এটা সম্ভব হয়েছে ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধ চর্চা এবং শিক্ষকদের ভূমিকা ও দায়িত্বশীলতার কারণে। এভাবে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যদি সচেতন হয় মাদক সংশ্রবমুক্ত হয়, তাহলে দেশ ও জাতির ভবিষ্যত নিয়ে এতটা বিচলিত হতে হবে না। সরকারকে মাদক বিরোধী কার্যক্রম আরো জোরদার করার পাশাপাশি এর সঙ্গে জনসংশ্লিষ্টতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন