সউদী আরবের সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যা মামলার রায়ে সুবিচার নিশ্চিত হয়নি অভিযোগ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা নিন্দা জানিয়েছে। মামলার প্রধান সন্দেহভাজন সউদী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নিরাপত্তা উপদেষ্টা খালাস পাওয়ায় নিন্দার ঝড় উঠেছে দেশটির বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।
গত বছরের ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সউদী কনস্যুলেটে প্রয়োজনীয় নথিপত্র আনতে গিয়ে সউদীর একদল ঘাতকের হাতে খুন হন রাজপরিবারের সমালোচক ও সাংবাদিক জামাল খাশোগি। দীর্ঘ তদন্ত শেষে দেশটির আদালতে ১১ জনের বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়।
কিন্তু সোমবার আদালত সউদী আরবের প্রভাবশালী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে ৫ জনকে মৃত্যুদন্ড এবং অপর তিনজনকে ২৪ বছরের কারাদন্ড দেয়।
সৌদির প্রসিকিউটরের কার্যালয় বলছে, খাশোগি হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্দেহে ৩১ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছিল। এর মধ্যে ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। পাঁচজনের মৃত্যুদন্ড, তিনজনকে ২৪ বছরের কারাদন্ড এবং বাকিদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে অভিযুক্ত এবং খালাস পাওয়া কারও নাম তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি।
সউদীআরবের ডেপুটি পাবলিক প্রসিকিউটর শালান আল-শালান বলেছেন, এই হত্যাকান্ড পূর্বপরিকল্পিত ছিল না; সেটি তদন্তে উঠে এসেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় খাশোগি হত্যার সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে নেয়া হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মুখপাত্র আহমেদ বেনচেমসি বলেছেন, খাশোগি হত্যার বিচার সন্তোষজনক নয়। শুরু থেকে এই মামলাটি নিয়ে অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করেছে সউদী আরব এবং এটি এখনও চলছে...। আমরা এখনও মুখোশ পরিহিত ঘাতকদের পরিচয় জানি না। কার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে আমরা সেটিও জানি না। 'এই হত্যার সঙ্গে সউদী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান-সহ ওপর মহলের কারা জড়িত তা জানতে তদন্তের চেষ্টাও চালায়নি সউদী প্রসিকিউটররা। এই হত্যাকান্ডে তারা কি ধরনের ভূমিকা পালন করেছে; সেটিও অজানা।'
সউদীযুবরাজ বিন সালমানের কঠোর সমালোচক খাশোগি স্বেচ্ছা নির্বাসনে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতেন। মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টে কলাম লিখতেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের অনুমতিও পেয়েছিলেন তিনি। গত বছরের ২ অক্টোবর তুরস্কে তার প্রেমিকাকে বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় নথি আনতে ইস্তাম্বুলে সউদী কনস্যুলেটে যান। সেখানে যাওয়ার পর থেকে তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ওই সময় খাশোগিকে কনস্যুলেটের ভেতরে সউদী আরবের পাঠনো একদল ঘাতক হত্যা করেছে বলে তুরস্ক অভিযোগ করে। সউদী আরব এ ঘটনায় নীরবতা পালন করে। পরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংস্থার সমালোচনার মুখে এক সপ্তাহ পর খাশোগি কনস্যুলেটের ভেতরে খুন হয়েছে বলে স্বীকার করে সউদী আরব। তবে এখন পর্যন্ত তার মরদেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
খাশোগি হত্যা মামলার রায় ঘোষণার পর তুরস্ক সউদীর এই রায়কে প্রহসনমূলক বলে বর্ণনা করেছে। তুরস্ক বলছে, দোষী ঘাতকদের মামলা থেকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, যারা একটি প্রাইভেট বিমানে করে ইস্তাম্বুলে ডেথ স্কোয়াড পাঠিয়েছিল...এবং এই হত্যাকান্ডকে আড়ালে রাখতে চেয়েছিল; তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো।
এমনকি এই মামলায় প্রধান সন্দেহভাজন খুনী এবং খাশোগির মরদেহ কোথায় রাখা হয়েছে সেব্যাপারে পরিষ্কার কোনো তথ্য প্রকাশ না করায় নিন্দা জানিয়েছে আঙ্কারা। বিচারিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে এটি সউদী কর্তৃপক্ষের মৌলিক ঘাটতি বলে দাবি করেছে তুরস্ক।
জাতিসংঘের বিশেষ দূত অ্যাগনিস ক্যালামার্ড এই মামলার রায়ের আগে এক প্রতিবেদনে খাশোগি হত্যার সঙ্গে সরাসরি সউদী যুবরাজের সংশ্লিষ্টতা আছে বলে দাবি করেছিলেন। তিনি বলেছেন, এই রায়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়নি।
এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, আঘাতকারীরা দোষী, তাদের মৃত্যুদন্ড হয়েছে। কিন্তু মূল হোতারা মুক্তি পেতে পারেন না। তদন্ত এবং বিচারে তাদের ছোঁয়া পর্যন্ত যায়নি। এটা বিচারবিরোধী। এটা এক ধরনের উপহাস।
প্যারিস ভিত্তিক সাংবাদিকদের মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস বলছে, এই রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচারকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। এতে ন্যায় বিচারে আন্তর্জাতিক মানদন্ডের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়নি।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সউদী আরবের এই রায়ের সমালোচনা করেছে। অ্যামনেস্টি বলছে, এই বিচার এক ধরনের হোয়াইটওয়াশ। এটি জামাল খাশোগি কিংবা তার প্রিয়জনদের জন্য ন্যায় বিচার কিংবা সত্য নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য সউদী আরবের আদালতের এই রায়ের প্রশংসা করেছে। সূত্র : আলজাজিরা, রয়টার্স।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন