কর্মজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৃথিবীব্যাপী জাতিসংঘের কর্মসূচীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অভিবাসন। মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে অবস্থান করলেও সে একই পৃথিবীর মানুষ। মানুষ হিসেবে তার অধিকার ধর্ম বর্ণ বা জাতীয়তার কারনে বৈষম্যের শিকার হতে পারে না। জাতিসংঘের আহ্বান হলো অভিবাসী শ্রমিক ও তার পরিবারের সদস্যদেরও অধিকার রয়েছে। অভিবাসীদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯০ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারন পরিষদে একটি সনদ গৃহিত হয়েছিল। এই সনদ অনুযায়ী পৃথিবীর সব মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন এবং সমমর্যাদা ও অধিকারের দাবিদার। এ সনদের ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালের ৮ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের ৫৫ তম অধিবেশনে ১৮ ডিসেম্বরকে বিশ্ব অভিবাসী দিবস ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশও যথাযোগ্য মর্যাদায় ২০০০ সাল থেকে বিশ্ব অভিবাসী দিবস পালন করে আসছে। প্রবাসীদের অনেকেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করে বৈষম্যের শিকার হয়ে, খেয়ে না খেয়ে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ পাঠিয়ে সমৃদ্ধ করছেন দেশের অর্থনীতি। বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, এশিয়া ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে অভিবাসী রয়েছেন। এসব দেশে তারা নানাভাবে বঞ্চনা, শোষণ ও অবহেলার শিকার হচ্ছেন। কখনো কখনো নির্যাতিত হচ্ছেন আবার অনেকেই ন্যায়বিচার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। কোনো কোনো দেশের কারাগারে বাংলাদেশীরা মানবাধিকার লংঘনের শিকার হচ্ছেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায় বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ১৩ শতাংশ বিদেশে কাজ করছে। দেশের টেকসই উন্নয়নে প্রবাসী আয় বাড়ানো খুবই জরুরী। টেকসই প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য কমাতে হলে নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করা একান্ত জরুরী । বিদেশে শ্রমিক প্রেরণের ক্ষেত্রে শ্রমিকরা যাতে হয়রানীর শিকার না হয় সেজন্য সরকারের তদারকি ব্যবস্থাও জোরদার করা আবশ্যক। অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশ যেতে নৌকা ডুবির ঘটনায় অনেক বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে পাওয়া গিয়েছিল অসংখ্য গণকবর।
ওয়ার্ল্ড মাইগ্রেশন রিপোর্ট ২০১৫ অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি সপ্তাহে ৩০ লক্ষ মানুষ শহরে আসে। বিশেষজ্ঞদের মতে বিশ্বে প্রতি ৩৫ জন মানুষের মধ্যে একজন অভিবাসী। যিনি নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে অন্যদেশে বসবাস করেন। বিশ্ব অর্থনীতির একটি বিরাট অংশ নির্ভর করে অভিবাসীদের শ্রমের উপর। এই বাস্তবতায় অভিবাসীদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করা সংশ্লিষ্ট সকলেরই দায়িত্ব। বাংলাদেশে দরিদ্রসীমার নিচে যে সমস্ত পরিবার রয়েছে তাদের যদি রেমিটেন্স প্রাপক পরিবারে রূপান্তর করা যায় তাহলে সেসব পরিবার দরিদ্র থাকবে না। দেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে। এটা সম্ভব হবে তখনই যখন অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অভিবাসীদের প্রেরিত অর্থ একটি বিরাট ভূমিকা রাখছে। বিশ্বের ১৬১টি দেশে বাংলাদেশের মানুষ কর্মরত আছেন। এ সমস্ত দেশে ১ কোটি ২৫ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক রয়েছেন। নিঃসন্দেেেহ এটি আনন্দের খবর, কিন্তু বেদনাও রয়েছে। তাদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ দক্ষ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে বিদেশ যাওয়া শ্রমিকদের ৬২ শতাংশ অদক্ষ, ৩৬ শতাংশ আধা দক্ষ এবং মাত্র ২ শতাংশ দক্ষ। প্রবাসী শ্রমিকদের বড় অংশই কর্মরত রয়েছে মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। এসব দেশেও আধুনিক প্রযুক্তি চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অদক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বিদেশে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিক পাঠানোর কোনো বিকল্প নেই। বিদেশ যাওয়া শ্রমিকদের সত্যিকারভাবে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আধুনিক ও উন্নত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এজন্য সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী।
প্রবাসীদের অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরো বাড়ানো যেতে পারে। দেশে বিনিয়োগের জন্য এবং বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর জন্য প্রবাসীদের আকৃষ্ট করতে হবে। প্রবাসীরা তখনই আকৃষ্ট হবেন যখন তারা দেশে বিনিয়োগ করার মতো একটি অনুকূল পরিবেশ ও নিরাপত্তার বিষয়ে নিশ্চিত হবেন। স্বাভাবিক কারনেই দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের কারনে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডার সমৃদ্ধ হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান রেমিটেন্স প্রবাহের কারনে বিশ্বমন্দাও দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারেনি, যা প্রমাণিত। বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন ব্যাংকে পড়ে আছে হাজার হাজার কোটি টাকা। বিনিয়োগ না হওয়ায় রেমিটেন্সের একটি বড় অংশ আলীশান বাড়ি, দামী গাড়ী ইত্যাদি অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হচ্ছে। সিলেটে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের জন্য অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। কৃষিভিত্তিক শিল্প, নির্মাণ সামগ্রীর কারখানা, পর্যটন শিল্প, বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করা যেতে পারে।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স শুধু ভোগেই নয়, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ব্যয় হয়। ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন, স্কুল-মাদ্রাসা, মসজিদ, হাসপাতাল স্থাপন সহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডেও ব্যয় হচ্ছে। দারিদ্র বিমোচন ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নে প্রবাসীদের রেমিটেন্সের ভূমিকা অসাধারন। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য মতে, রেমিট্যান্স আয়ের প্রায় ৬৩ শতাংশ ব্যয় হয় দৈনন্দিন খরচের খাতে। এতে ঐ পরিবারগুলো দারিদ্র দূর করতে পারে। রেমিটেন্স পাওয়ার পরে একটি পরিবারের আয় পূর্বের তুলনায় ৮২ শতাংশ বাড়ে। রেমিটেন্স সবচেয়ে বেশী অবদান রাখতে পারে বিনিয়োগের মাধ্যমে। রেমিটেন্সের মাধ্যমে গ্রামীন জনগোষ্ঠির আয় ও সঞ্চয় বাড়ার কারনে গ্রামীন অঞ্চলে বিনিয়োগ বাড়ে। যার ফলশ্রæতিতে সেখানে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরী হয়। যারা বিদেশে যান তাদের বেশীর ভাগেরই পরিবার গ্রামে থাকায় তাদের ব্যয় বেড়ে গ্রামীন অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের দারিদ্র দূরীকরণে প্রধান ভূমিকা রাখছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। প্রবাসীদের পাঠানো টাকা ভোগে ব্যয় হয় বলে একটি নেতিবাচক প্রচারনা আছে। যদি তাও হয় তবুও মনে করি দেশের সামগ্রীক অর্থনীতিতে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্স এক বড় ধরনের ভুমিকা রাখে।
গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বহু উন্নয়ন ঘটেছে। সামাজিক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। জিডিপি বাড়ছে এবং ফরেন কারেন্সী রিজার্ভও বাড়ছে অব্যাহতভাবে। শিক্ষা, নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এগিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বাংলাদেশকে আরও অনেক আগেই পরবর্তী উদীয়মান বাঘ বলে অভিহিত করেছেন। এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে প্রবাসীরা যাতে দেশে বিনিয়োগ করেন সেজন্য একটা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিদেশে লাখ লাখ মানুষ কাজ করতে যাওয়ার কারনে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে। দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি কম বড় কথা নয়। এটি একটি বড় অর্জন। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করছে রেমিটেন্স প্রবাহ। বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশকে সম্ভাবনার বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে অভিহিত করেছে। এসব অর্জন থাকা সত্তে¡ও প্রবাসীদের জীবন বদলায়নি। তারা নিজ দেশে এসে দেখেন বিমান বন্দরের সেই বেহাল অবস্থা। রাস্তায় অসহনীয় যানজটের কারনে আটকে থাকেন ঘন্টার পর ঘন্টা। সড়ক দূর্ঘটনাও নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। কারনে অকারনে অনেকের সম্পত্তিও বেদখল হয় যা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়।
রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়াতে হলে প্রবাসীদের জন্য বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রে একটা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। রেমিটেন্স প্রবাহ কমে গেলে দেশের সামগ্রীক অর্থনীতিতে এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে বাধ্য। পাশাপাশি রেমিটেন্স প্রবাহ উত্তোরত্তর বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোর ব্যাপারে কার্যকরী উদ্যোগ রাখতে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের কার্যকরী ভূমিকা থাকা দরকার। লেখক: গবেষক এবং সভাপতি, বৃটিশ বাংলাদেশি ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন, মৌলভীবাজার জেলা শাখা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন