১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিংশ শতকের সর্ব শেষ মুসলিম ব্যক্তিত্ব আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিখ্যাত আলেমে দ্বীন আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ:) এর ইনতেকালের খবরে গোটা মুসলিম বিশ্বে (তাঁর জন্ম স্থান ভারত সহ) গভীর শোকের যে ছায়া নেমে এসেছিল তা ছিল এক বিরল ঘটনা। বাংলাদেশেও এ শোকাবহ ঘটনার প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। বিশেষত; এখানকার সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে দেশের উলামা সমাজের শোকবাণী গুরুত্ব সহকারে প্রচারের ‘দৈনিক ইনকিলাব’ এর ভ‚মিকা ছিল অগ্রণী। বিশেষত এ পত্রিকার উপসম্পাদকীয় সহ বিভিন্ন পাতা আল্লামা নদভী (রহ:) এর জীবন ও কর্মের উপর বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাপা হতে থাকে, সেটা এখন থেকে দুই দশক আগের কথা। বাংলাদেশে হজরত আল্লামার প্রত্যক্ষ-সরাসরি ছাত্র, যোগ্য উত্তরসূরির সংখ্যা কম নয়। তারাই আল্লামা আবুল হাসান নদভী (রহ:) কে চির স্মরণীয় করে রাখার অধিক হকদার। হজরত আল্লামার ওফাত বার্ষিকী স্মরণে এই বিশেষ নিবন্ধ।
‘হিমালয়ান’ উপমহাদেশের ঐতিহাসিক স্থান, ইসলামী পুনর্জাগরণ ও জিহাদ আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র রায়বেরেলীর ঐতিহ্যমন্ডিত দায়েরায়ে শাহ আলামুল্লাহ (রহ:) এর তাকিয়াকালা হতে উত্থিত জিহাদ এই উপমহাদেশে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সূচনা করবে, এরূপ ধারণা হয়ত অনেকেরই ছিল না। হজরত শাহ আলামুল্লাহ (রহ:) এর পঞ্চম অধঃস্তন পুরুষ মোজাহেদে আজম হজরত সৈয়দ আহমদ শহীদ (রহ:) সেই প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রেরই প্রবক্তা। ১৮৩১ সালের ৬ মে তারিখে বালাকোটে তিনি ও তাঁর প্রধান সহকর্মী হজরত ইসমাঈল শহীদ (রহ:) এর মর্মান্তিক শাহাদাতের পরও বহুকাল জিহাদ আন্দোলন বিক্ষিপ্তভাবে নানাস্থানে অব্যাহত থাকে। ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পরিস্থিতি নতুন আকার ধারণ করে এবং মুসলমানদের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ বিরোধী চিন্তাচেতনার এক নব পর্যায় আসে ‘কলমী’ জিহাদ রূপে।
হজরত আল্লামা নদভী ভারতের উত্তর প্রদেশের রায়বেরেলীতে ১৯১৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বিশ^বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদওয়াতুল উলামাতে উচ্চ শিক্ষা লাভ করার পর সেখানে তিনি অধ্যাপনা করতে থাকেন এবং দীর্ঘকাল তিনি উহার রেক্টর পদে অধিষ্ঠিত থাকার পর বিগত ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৯ সাল ৮৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। এভাবে বিংশ শতকের একজন সর্বশেষ বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ, অনন্য সাধারণ প্রতিভা, ইতিহাসবেত্তা, লেখক-সাহিত্যিক, সংস্কারক এবং আরবী ভাষা ও সাহিত্যের অত‚লনীয় পান্ডিত্যের অধিকারী মনীষীর জীবনাবসান ঘটে। নদওয়াতুল উলামার মহাপরিচালক আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী ছিলেন বিংশ শতকের সর্বশেষ সেরা ইসলামী ব্যক্তিত্ব, তাঁর মত দুনিয়া জোড়া খ্যাতি-সম্মান তাঁর সমসাময়িক আর কারো পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয়েছে কিনা সন্দেহ।
১৯১৪ থেকে ১৯৯৯ সালের শেষ দিন পর্যন্ত এ দীর্ঘকালের মধ্যে ছাত্র জীবনের কুড়ি বছর বাদ দিলে আল্লামা নদভীর কর্মময় জীবন ৬৫টি বছরের কীর্তিমালা ও অবিস্মরণীয় অবদানগুলি বিশাল আকারের। নদওয়াতুল উলামার শিক্ষক হিসাবে তিনি ১৯৩৪ সালের যোগদান করেন। অধ্যাপনার সাথে সাথে তিনি যে বহুমুখী ভ‚মিকা পালন করেন তা রীতিমত বিস্ময়কর। তাবলীগ-প্রচার, গ্রন্থ রচনা, দেশ বিদেশে ব্যাপক সফর, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান-সংগঠন-সংস্থা প্রতিষ্ঠা, সাংবাদিকতা, উপরক্ত নদওয়ার উন্নয়ন তৎপরতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে আল্লামা নদভীর সঠিক মূল্যায়ন এক দূরহ ব্যাপার, তিনি একটি একাডেমিক বিশাল প্রতিষ্ঠান হিসাবে মুসলিম বিশে^ যে সর্বোচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন তার পরিমাপ ও মূল্যায়ন করা এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে সম্ভব নয়।
বিভিন্ন ভাষায় দুই শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা হজরত আল্লামা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ:) তাঁর গৌরব মন্ডিত বংশের পরিচিতি তুলে ধরার সাথে সাথে এই বংশের মহান মনীষীদের অনেকের পরিচয়-কীর্তির বিবরণও প্রদান করেছেন, এমনকি তাঁর সমকালীন এবং ওস্তাদ-মাশায়েখের অনেকের জীবন-চরিতের নানা দিক নিয়েও আলোচনা পর্যালোচনা করেছেন। বিভিন্ন প্রবন্ধ-রচনা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রসঙ্গক্রমে তাঁর গ্রন্থাবলীর মধ্যে ‘সীরাত সৈয়দ আহমদ শহীদ’ ও হায়াতে আবদুল হাই এদুটি গ্রন্থ হতে আল্লামা নদভীর বংশ ও তাঁর মহান পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত হওয়া যায়। গ্রন্থ দুইটির বরাত দিয়ে অনেকেই তাঁদের সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তিনি “মীরে কারাওয়ান” নামক সাত খন্ডে প্রকাশিত গ্রন্থে তাঁর জীবনের অনেক কথাই লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর বংশ পরিচয় সম্পর্কে পরবর্তী বিবরণগুলো আল্লামা আলী মিয়া নদভীর বিক্ষিপ্ত বিভিন্ন রচনার আলোকে সংকলিত হয়, যার নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ^স্ততা সন্দেহাতীত ভাবে স্বীকৃত বলে গণ্য হয়ে থাকে। আল্লামা নদভীর আরবী রচনাবলীর মধ্যে এমন রচনার সংখ্যা অধিক যেগুলো আরবদের লক্ষ্য করেই রচিত হয়েছে। এসব পুস্তক পুস্তিকার নামগুলো উল্লেখ করা হলে স্পষ্ট বুঝা যাবে যে, আরবদের একজন হিতাকংঙ্খী উপদেষ্টা হিসাবে তিনি কি পরিমাণ অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।
ভারতীয় মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা, অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং শিরক ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আল্লামা নদভী আজীবন নিরলস সংগ্রাম করে যান। সেখানে মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে চক্রান্ত বানচাল করার লক্ষ্যে তিনি লেখনী পরিচালনা করেন এবং সভা সমাবেশ করে মুসলিম জনমত গড়ে তোলেন। ভারতীয় মুসলমানদেরকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির ব্যাপারে তাঁর বিভিন্ন কর্মসূচী ও বাস্তব পদক্ষেপ যথেষ্ট সহায়ক ও অনুক‚ল প্রভাব বিস্তার করেছিল। এ ক্ষেত্রে তিনি ভারতীয় মুসলমান ও আলেম সমাজের দায়িত্ব সচেতনতায় অতন্ত্র প্রহরীর ভ‚মিকা পালন করেন। ভারতে শিরক ও অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি একজন নির্ভীক ও অভিভাবক হিসাবে সোচ্চার ছিলেন। ‘বন্দে মাতরম’ ও সরস্বতি বন্দনা সংক্রান্ত হজরত আল্লামা নদভীর একটি সত্য ভাষণকে কেন্দ্র করে ভারস সরকার তাকে অপদস্ত করার যে হীন চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল,আল্লাহ তাকে সে সময়ও সাহায্য করেছেন। উল্লেখ্য যে, ভারতের উত্তর প্রদেশ সরকার ১৯৯৪ সালের নভেম্বর মাসে আল্লামা নদভী পরিচালিত ‘নদওয়াতুল উলামা’ এর বিরুদ্ধে একটি ভিত্তিহীন অযিযোগে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তদন্ত বিভাগ কর্তৃক পুলিশী হামলা এবং ১৯৯৮ সালের শেষ দিকে হজরত আল্লামার রায়বেরেলীসহ বাড়ীতে উত্তর প্রদেশ সরকার কর্তৃক তল্লাশীর নামে পুলিশী অভিযান পরিচালনা ছিল অত্যন্ত বর্বরোচিত ঘটনা। ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার দ্বয়ের এহেন পুলিশী হামলা নদওয়া ও আল্লামা নদভীর মর্যাদা ক্ষুন্ন করতে পারেনি। ভারত সরকারের এ ন্যাক্কারজনক ঘটনা কেবল ভারত নয়, সারা বিশে^র মুসলমানদের আবেগ অনুভ‚তিতে চরমভাবে আঘাত করে এবং সমগ্র মুসলিম বিশে^ তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। মুসলমানদের প্রাচীনতম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বাবরী মসজিদ ধ্বংসের ন্যায় নদওয়াতুল উলামার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের এহেন ধৃষ্টতা প্রদর্শনকে ঘৃণ্যতম আচরণ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী একজন পর্যটক হিসাবেও খ্যাত ছিলেন। তিনি দেশ বিদেশের অনেক স্থানে ব্যাপক সফর করেছেন। তিনি যে স্থানেই গমন করেছেন সে স্থানকে একজন অভিজ্ঞ পর্যটক ও ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে দেখেছেন। সে স্থানের ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরেছেন। সে স্থানের পরিবেশ, ধর্মীয় সংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর আলোকপাত করেছেন। বিশেষত: ধর্মীয় পরিবেশ ও সাধক উলামা মাশায়েখ , কবি সাহিত্যিক এবং সেখানকার ভাষা, সাহিত্য ও গুণীজনদের অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন।
উদাহরণ স্বরূপ বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এ দেশে সর্বপ্রথম তিনি আগমণ করেন ১৯৮৪ সালের মার্চ মাসে। এখানে দশদিন ব্যাপী অবস্থানকালে তিনি রাজধানী ঢাকা, সাবেক রাজধানী সোনার গাঁ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, রাজশাহী প্রভৃতি স্থান পরিদর্শণ কালে বিভিন্ন সমাবেশ-সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। তাঁর বিভিন্ন ভাষণ বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা বলতে গিয়ে সাধক, মাশায়েখ ও আলেম সমাজের অবদানের কথা বর্ণনা করেন এবং আলেম সমাজকে বাংলা ভাষা চর্চা ও এই ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির আহ্বান জানান।
তিনি বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাদেরকে নেতৃত্বদানের যোগ্যতা সৃষ্টির উপদেশ প্রদান করেন এবং বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্যের বিরাট সমাহার সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ তৈরির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি সমাজের ইসলামী পরিবেশ দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং এদেশের আলেম ‘খেদমতে খালক’- মানবতার সেবায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। আল্লামা নদভী এ প্রসঙ্গে খৃষ্টান মিশনারী ও এনজিওদের সেবাধর্মী তৎপরতার উল্লেখ করেন এবং ওদের খৃষ্টান বানানোর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে আলেম সমাজকে সতর্ক ও সাবধানে থাকার আহ্বান জানান।
এখন থেকে কুড়ি বছর পূবের্র আল্লামা নদভীর এসব মূল্যায়ন আজো সমভাবে প্রযোজ্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন