শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

অর্থ পাচার রুখতে-

প্রকাশের সময় : ২৮ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে। অর্থ পাচারের দিক থেকে শীর্ষ ১০০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০। এর বাইরে গত দুই অর্থবছরে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশী নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। আবার মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে গত ১৩ বছরে ৩ হাজার ৬১ জন বাংলাদেশী অর্থ পাঠিয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক প্রতিবেদনে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাচার হয়েছে, বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯৬৬ কোটি ডলার পাচার হয়েছে ২০১৩ সালে। অত্যন্ত বিস্ময়কর ব্যাপারÑ যে দেশে বছরের পর বছর ধরে বিনিয়োগ খরা চলছে, সে দেশ থেকে প্রতি বছর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। পাচার হওয়া এই টাকা বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে। বিনিয়োগ প্রত্যাশী একটি দেশ থেকে যখন বিনিয়োগযোগ্য অর্থ এভাবে অন্য দেশে বিনিয়োগ হয় তখন ওই দেশটির অর্থনীতি ও উন্নয়নের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত ও বিচলিত না হয়ে পারা যায় না। কেন ক্রমবর্ধমান হারে টাকা পাচার হচ্ছে, এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেয়া সম্ভব নয়। নানা কারণ, নানা আনুষঙ্গিক কারণ এর পেছনে রয়েছে। যে টাকা পাচার হয়ে বিদেশে বিনিয়োগ হচ্ছে, সে টাকা দেশেও বিনিয়োগ হতে পারত। হচ্ছে না কেন? অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মতে, দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ নেই। রাজনৈতিক স্থিতি, আইন-শৃঙ্খলার সুষ্ঠুতা, নাগরিক নিরাপত্তা, পুঁজির লাভ ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, আর্থিক সুনীতি, উপযুক্ত আইন-কানুন, প্রশাসনের কার্যকর সহযোগিতা, অবকাঠামো সুবিধা ও প্রয়োজনীয় উপকরণাদির সহজপ্রাপ্যতার অভাবহেতু কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ পরিবেশ অনুপস্থিত। এমতাবস্থায়, অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে বাধ্য হয়ে এবং অন্যান্য দেশে তা বিনিয়োজিত হচ্ছে নানা ক্ষেত্রে।
এ কথা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, দীর্ঘদিন ধরে দেশ বিনিয়োগ বন্ধ্যাত্বের কবলে পড়ে আছে। বিদেশী যেমন তেমনি দেশী বিনিয়োগ প্রবাহও মন্থর। বিনিয়োগ প্রত্যাশানুপাতে না হওয়ায় শিল্পায়ন দ্রুতায়িত হচ্ছে না, কর্মসংস্থান সেভাবে বাড়ছে না, উৎপাদন-রফতানির আশা লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না। অথচ এযাবৎ যত অর্থ পাচার হয়ে গেছে, তা দেশেই বিনিয়োগ হলে দেশের অবস্থা এখন অন্য রকম দেখা যেত। বিনিয়োগের যে পূর্বশর্তগুলো আছে, তার অভাব বা স্বল্পতা অর্থকে ঠেলে দিচ্ছে বিদেশে। দেশে দুর্নীতি ব্যাপক ও অবিশ্বাস্য মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের পরিমাণও বেড়েছে। সঙ্গত কারণেই এ অর্থের গন্তব্যস্থল হয়েছে বিদেশ। দুর্নীতিবাজরা বিদেশে অর্থ পাচার করেছে তা গোপন রাখার জন্য এবং লাভের জন্য। সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করেছে অসৎ ব্যবসায়ীরা। তারা আমদানি-রফতানিতে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে এ অর্থ পাচার করছে। অনেক ব্যবসায়ী অর্থের নিরাপত্তার বিবেচনায়ও অর্থ পাচার করেছে। জাতীয় স্বার্থেই অর্থ পাচারের সব পথ রুদ্ধ করা উচিত। অনেকের মতে, আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পারস্পারিক সমন্বয়-সহযোগিতা সম্প্রসারণ, পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা ইত্যাদি অর্থ পাচার প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এ অভিমতে দ্বিমত পোষণ না করেইও অন্যরা মনে করেন, বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলেই তা অর্থ পাচার রোধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারত।
বিনিয়োগের কাক্সিক্ষত পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে অবশ্যই রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অস্থিরতার আশঙ্কা দূর করতে হবে। স্বীকার করতেই হবে, সাম্প্রতিক বছরগুলো রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা ও হানাহানির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা বেড়েছে। আপাতত শান্ত মনে হলেও ভেতরে ভেতরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। যে কোনো মুহূর্তে এর বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। তাই আগে যেমন তেমনি এখনো ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে আস্থা খুঁজে পাচ্ছে না। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির শোচনীয় অবনতির কথাও কারো অজানা নেই। মানুষের জানমালের ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই। এমতাবস্থায়, কিসের আশায় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে? আইনের শাসন বলতে দেশে কিছুই নেই। সুবিচার-ন্যায়বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন বলেছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতাই টাকা পাচারের অন্যতম কারণ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেছেন, সুশাসনের অভাবই অর্থ পাচারের মূল কারণ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জানমালের নিরাপত্তার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, যখন কেউ মনে করে জীবনের বা সম্পদের নিরাপত্তা নেই তখন সে বিদেশে টাকা পাচার করে। টাকা পাচার রোধ এবং বিনিয়োগ বাড়াতে সর্বাগ্রে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ করতে হবে। জানমালের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অবিলম্বে এসব দিকে নজর দেয়া হবে, এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন