শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

জাতীয় স্বার্থকেই সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু করতে হবে

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক | প্রকাশের সময় : ৫ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

২০১৯ সালের ১২ মাসের পর্যালোচনা এই সংক্ষিপ্ত কলামে সম্ভব নয়। তাই দেশের ভেতরে ও বাইরের মাত্র দুই-চারটি ঘটনা, যেগুলো শেষ দুই-এক মাসে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে, সেগুলো উল্লেখ করছি। দেশের ভেতরে অন্যতম বড় ঘটনা হয়েছে আওয়ামী লীগের একাদশ সম্মেলন। অনেক বড় এবং সুন্দর মঞ্চ হয়েছিল, মঞ্চটি দেখে সবাই মুগ্ধ হয়েছেন। অনেক প্রচারণা হয়েছিল নতুন মুখ আসবে, নতুন মুখ আসবে এই বলে; কিন্তু আসলে নতুন মোড়কে পুরনো মুখগুলোকেই উপস্থাপন করা হলো। যাই হোক, নতুন কমিটিকে অভিনন্দন। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের প্রতি উপযুক্ত সম্মান জানানো হয়েছে, তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আশা ছিল, অতীতের অনেক মন্দ অভ্যাস থেকে ব্যতিক্রম হবে; দুঃখজনক হলেও সত্য, হয়নি। অনেক মরহুম নেতার নাম উল্লেখ করে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে, কিন্তু ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত এমএনএ ও মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধান সেনাপতি কর্নেল (পরে জেনারেল) মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর নাম অবহেলিত থেকেছে। বিশ্ববাসীর উদ্দেশে এবং দেশবাসীর উদ্দেশে যিনি প্রথমে নিজের নামে এবং অব্যবহিত পরে বঙ্গবন্ধুর নামে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, সেই মেজর (পরে মেজর জেনারেল) জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের নাম উচ্চারিত হয়নি। ১৯৮৩ থেকে নিয়ে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও এরশাদের দল এবং আওয়ামী লীগ, কঠিন ও স্পর্শকাতর সময়গুলোতে পারস্পরিক সমর্থন ও সহমর্মিতায় পথ চলেছে, সেই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে এক হাত নিতে দলীয় অভিভাবক মহোদয়া পিছপা হননি। দেশের ভেতরে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ডাকসু নামক বিখ্যাত সুপরিচিত সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত সহসভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর উপর্যুরি আক্রমণ এবং আক্রমণ করে তাকে ও তার অনেক সঙ্গীকে শারীরিকভাবে গুরুতর জখম করা। আক্রমণকারীদের মধ্যে রয়েছে সরকারি দলের সমর্থনের দাবিদার ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামক একটি সংগঠনের কর্মী এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নামক ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একটি অংশের কিছু কর্মী। এদের কথা তুলে ধরার পেছনে কারণ হলো, একদিকে সরকারি বা ক্ষমতাসীন দল দৃশ্যত গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে নিজেদের অভ্যন্তরীণ কর্মকান্ড পরিচালনা করার উদাহরণ সৃষ্টিতে সচেষ্ট; অপরদিকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ডাকসু নামক প্রতিষ্ঠানের সহসভাপতি এবং ভিন্ন মতাবলম্বী অন্যান্য নেতাকে, একমাত্র ভিন্নমতের কারণেই দুনিয়া থেকে বিদায় দিতে সচেষ্ট! এই স্ববিরোধিতা আওয়ামী লীগ নামক প্রখ্যাত ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের জন্য কারো কারো মতে স্বাভাবিক, কারো কারো মতে অস্বাভাবিক।
বিগত বছরের তথা ২০১৯ সালের ১২ মাসের আন্তর্জাতিক ঘটনার সারমর্ম এখানে তুলে ধরা সম্ভব নয়, সময় এবং স্থান কুলাবে না। শুধু শেষের দুই-এক মাসের ঘটনাবলির মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য দুই-একটি তুলে ধরছি। একটি ঘটনা হলোÑ ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে ব্রিটেন বা যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট নির্বাচন। দ্বিতীয় ঘটনা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নি¤œকক্ষে তথা হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ইমপিচ বা অভিশংসিত করার জন্য প্রস্তাব পাসের ঘটনা। তৃতীয় ঘটনা হলোÑ মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে, ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সদস্যদের মধ্য থেকে ১৮-২০টি দেশের একটি আলাদা সম্মেলন, যেখানে অন্যতম প্রধান চরিত্র ছিলেন মাহাথির মোহাম্মাদ এবং রজব তাইয়েব এরদোগান। চতুর্থ ঘটনা হলোÑ ইউরোপ মহাদেশের ‘দ্য হেগ’ নামক একটি মহানগরীতে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে মিয়ানমারের অভিযুক্ত হওয়া। ইংরেজিতে বলেÑ ‘লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট’ তথা বাংলায় সর্বশেষে উল্লিখিত হলেও গুরুত্বে সর্বশেষ নয় এমন তথা পঞ্চম ঘটনাটি হলো, বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা ইংরেজিতে সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট পাস হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ ও প্রতিবাদী গণআন্দোলন।
গত ১১টি বছর বাংলাদেশ শাসন করছে একটি রাজনৈতিক দল। এই দলের শাসনামলে ভালো কাজ যেমন হয়েছে, তেমনই মন্দ কাজও হয়েছে; এটাই স্বাভাবিক। তবে যেটা স্বাভাবিক নয় সেটি হচ্ছে, মন্দ কাজের ওজন এবং ভালো কাজের ওজনের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা; মন্দ কাজগুলোর ওজন বেশি। বর্তমান সরকারের আমলে, মানুষের যে ভোট দেয়ার অধিকার, সেটি সম্পূর্ণ নস্যাৎ হয়েছে। ২০১৪ সালে সম্পূর্ণ ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়েছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনটি আগের রাতেই সম্পন্ন হয়ে গেছে। এ ধরনের মারাত্মক অন্যায় কাজ করেও সরকার টিকে আছে দুটো কারণে। একটি কারণ হলো, তারা বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি সরকারপ্রিয়, অন্ধভাবে আওয়ামী লীগ-বান্ধব অংশ সৃষ্টি করতে পেরেছে। এইরূপ একটি অন্ধভাবে আওয়ামী লীগ-বান্ধব জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করতে গিয়ে, এই সরকার যে কয়টি অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তার মধ্যে প্রধান হলো, মুক্তিযুদ্ধ। সরকার একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে নিজেদের অবস্থান জাহির করতে থাকে এবং অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান ও ক্রিয়া জাহির করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে থাকতে গিয়ে সরকার, প্রতিবেশী ভারতের সাথে অতি সখ্যতায় জড়িত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত নামক রাষ্ট্রটি বাংলাদেশে এমন একটি সরকার চায় যেই সরকার ভারতের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক নিরাপত্তায় সহায়ক হবে। আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক দলটি চায়, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সরকার যেন তাদের প্রতি সর্বদাই শুভেচ্ছামূলক সম্পর্কের দৃষ্টি রাখে। উভয় পক্ষের জন্যই কমন অস্ত্র হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া সুসম্পর্ক। রাখঢাক ব্যতীতই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সরকার এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, ভারতের প্রতি সর্বাঙ্গীণভাবে সর্বদাই কৃতজ্ঞ থাকার কথা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার কথা উচ্চারণ করতে থাকে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, তৎকালীন ভারত সরকার বাংলাদেশের প্রতি ও বাংলাদেশের জনগণের প্রতি যেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, সেটা ইতিহাসে ব্যতিক্রমধর্মী। সেখানে মানবিকতা যেমন জড়িত ছিল, তেমনই ভারতের রাজনৈতিক স্বার্থ ও নিরাপত্তা স্বার্থ উভয়টি জড়িত ছিল। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি গত ৪৮টি বছর তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সীমারেখা কোথায়, এটা কোনো দিনই আলোচনায় আসেনি বা কেউ প্রকাশ্যে আলোচনা করতে উদ্যোগী হয়নি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, সবার মধ্যে না হলেও একটা বিরাট অংশের মধ্যে এই মর্মে একটি ধারণা বিদ্যমান যে, ভারত সরকারের শুভেচ্ছামূলক দৃষ্টি না থাকলে, বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আরোহণ করতে পারবে না বা আরোহণ করলেও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। আমার দৃষ্টিতে এইরূপ ধারণা ভ্রান্ত। আমার দৃষ্টিতে এইরূপ ধারণা জাতীয় হীনম্মন্যতার পরিচয়। আমার দৃষ্টিতে এইরূপ ধারণা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের প্রতি আনুগত্যের দুর্বলতার পরিচয়। আজ ২০১৯ সালের শেষে এবং ২০২০ সালের প্রথম দিনে বলতেই হবে যে, শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, পৃথিবীর বহু জায়গাতেই জাতীয়তাবাদী শক্তির উন্মেষ ঘটছে। গেøাবালাইজেশন বা বিশ্বায়ন নামক চলমান প্রক্রিয়ার সীমারেখা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। জাতীয় স্বার্থের সুপ্রিমেসি তথা জাতীয় স্বার্থের চূড়ান্ত আধিপত্য এবং তার সাথে গেøাবালাইজেশন বা বিশ্বায়নের যে দ্বন্দ্ব, সেখানে জাতীয় স্বার্থের প্রতি অনুগত চিন্তা-চেতনার পুনরায় উন্মেষ ঘটছে। কিন্তু গত এগারোটি বছর অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও আবেগকে ব্যবহার করে, বাংলাদেশের মানুষের মন-মানসিকতাকে জাতীয় স্বার্থের সুপ্রিমেসির পরিপন্থী করে গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে। যেন এই চেষ্টা টিকে থাকে তার জন্য রাষ্ট্রের তথা সরকারের সর্বপ্রকারের শক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। মিডিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থনৈতিক অঙ্গনকে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিরক্ষা অঙ্গনকে ব্যবহার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলার অঙ্গনকে ব্যবহার করা হয়েছে। এতদসত্তে¡ও ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আমরা বলতে বাধ্য যে, বাংলাদেশের মানুষ, ক্ষমতাসীন সরকারের দৃষ্টিতে দুই ভাগে বিভক্ত, যথাÑ স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি ও স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মতে, বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের মতে, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত মানুষের মতে, প্রতিবাদ করতে না পেরে বিক্ষুব্ধ মনে জীবন যাপন করছে এমন মানুষের মতে, এটা সত্য যে, বাংলাদেশের মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত কিন্তু সেই দুটি ভাগ হলো এইরূপÑ যথা: ভারতপন্থী এবং ভারতবিরোধী। গত এগারোটি বছরে বর্তমান সরকারের আমলে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পারস্পরিক যত প্রকারের বন্দবোস্ত হয়েছে, সেখানে উপকার বা বেনিফিটের পাল্লা ভারতের পক্ষে গিয়েছে বলেই বাংলাদেশের মানুষ এখন এইরূপ মনে করছে।
গত বছরটি ভারতের ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনশিপ তথা এনআরসি নিয়ে ভীষণ তোলপাড় ছিল। কেন্দ্রবিন্দু ছিল আসাম। অভিযোগ ছিল, অন্ততপক্ষে ২০-২৫ লাখ বাংলাদেশী মুসলমান অনুপ্রবেশকারী আসামে বসবাস করছে এবং এদেরকে বের করে দিতে হবে। তালিকা প্রকাশের পর দেখা গেল যাদেরকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের মধ্যে তিন ভাগের দুই ভাগই হিন্দু ধর্মের। তাৎক্ষণিকভাবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নতুন কৌশল নির্ণয়ে মনোনিবেশ করল। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট পাস হয়ে গেল! পাস হওয়ার পর দেখা গেল, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এই সংশোধিত আইনের বিপক্ষে তুমুল প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। প্রতিবাদের ভিত্তিতে মানবিকতা এবং আইনের শাসনের পক্ষে। বাংলাদেশের ইমিডিয়েট প্রতিবেশী এবং প্রাচীনতম প্রতিবেশী হচ্ছে পশ্চিবঙ্গ নামক প্রদেশ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ নামক প্রদেশটিতে বিরাজমান শক্তিশালী তৃণমূল কংগ্রেস নামক রাজনৈতিক দল ও সেই দলীয় সরকার, জোরালোভাবেই সংশোধিত আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। সংশোধিত আইনটির সবচেয়ে মারাত্মক ত্রুটি হলো, এটি মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করছে এবং স্পষ্ট ও প্রকাশ্যভাবে মুসলমানগণকে বৈরী ঘোষণা করছে। পশ্চিমবঙ্গের সরকার, ভারতের আরো কয়েকটি প্রদেশের সরকার, সর্বভারতীয় কংগ্রেস নামক ভারতের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল, বহু ডজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাত্ররা, সুপরিচিত বুদ্ধিজীবীরা সবাই এরূপ বিভাজনকে ভারতের মৌলিক সাংবিধানিক চেতনার পরিপন্থী বলে মনে করেন। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার নামক রাষ্ট্রটি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর দিয়ে অত্যাচার চালানোর পেছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি কারণ ছিল যে, রোহিঙ্গারা মুসলমান। ভারতেও, ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা মুসলমান, তাদেরকে কোণঠাসা করার জন্য সংশোধিত আইনটি পাস হয়েছে। অপর ভাষায় বলা যায়, কট্টর হিন্দুত্ব বা হিন্দুত্ববাদিতা কায়েমের জন্যই আইনটি পাস হয়েছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বারবার বলছে, এই আইনের বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং বাংলাদেশের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই, তথাপি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হয়ে পারে না। কারণ, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে কথা বলার মতো শক্তিশালী রাজনৈতিক মঞ্চ পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সরকার ভারতের কথাকে বিশ্বাস করছে। বিশ্বাস করাটা দোষের নয়। মানুষে মানুষে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক বিশ্বাস নামক একটি উপাত্ত জরুরি। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের বিষয়, তিস্তার পানির বিষয়, যৌথ নদী কমিশনের বিষয়, আন্তদেশীয় বাণিজ্যে অ-শুল্ক বাধা দূর করার বিষয়, ট্রানজিটের বিষয় এই সবকিছু মূল্যায়ন করলে দেখা যায় যে, ভারতের প্রতি যে বিশ্বাস সেটা অত্যন্ত নড়বড়ে। কথিত আছে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশকে দিতে চায়, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের জন্য পারছে না; অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার বাংলাদেশের স্বার্থের বিপরীতে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আবার, পশ্চিম বঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের দারুণ বিরোধিত করছে এবং সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের সব ধর্ম-বর্ণের মানুষকে একই মানবিক ও আইনি দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার বিষয়টি জোরালোভাবে প্রচার করছে। একটি আঙ্গিকে বাংলাদেশীরা, কলকাতার প্রতি বিরূপ মনোভাব নিতে পারে, অপর আঙ্গিকে কলকাতার প্রতি সমর্থনীয় মনোভাব নিতে পারে। এই দুই প্রকারের মনোভাবের কারণ কী? কারণ বা কারণগুলো ঢাকায় একরকম হবে, কলকাতায় আরেকরকম হবে। কলকাতায় যেই কারণটি উজ্জ্বল, সেটি হলো- তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বার্থ। ঢাকার কারণটি হবে আবেগভিত্তিক। আমি সার্বিকভাবে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে এই আবেগভিত্তিক বিবেচনা বা আবেগভিত্তিক প্রবাহের বিপক্ষে। এই ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, যে দুই-চারটি রাজনৈতিক আহŸান করতে পারি, তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী আহ্বানটি হবে, এই আবেগভিত্তিক বিবেচনা ও প্রবাহের বিপক্ষে। আমি চাই, আকাশে-বাতাসে বাংলাদেশ নামক শব্দটি ধ্বনিত হোক এবং একমাত্র বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থই সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু হোক। যতদিন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাংলাদেশের স্বার্থ প্রাধান্য পাবে না, ততদিন বাংলাদেশের অগ্রগতি ও উন্নতি নিরঙ্কুশ হবে না।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন