বছর পরিক্রমায় আবারও মাহে রমজান আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছে। রমজানের ফজিলত পেতে প্রত্যেক মুসলমানই উদগ্রীব হয়ে থাকে এই মাসটির জন্য। পূর্ণ ফজিলত পেতে হলে রমজানের প্রত্যেকটি কাজই কোরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক হতে হবে এটাই শর্ত। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে সারাটা দিন আমরা না খেয়ে থাকি। মুখে বা দাঁতের আটকে থাকা কোন খাবার পেটে চলে গিয়ে যাতে রোজা নষ্ট না হয় সেইদিকে যেমন খেয়াল রাখতে হয় ঠিক তেমনি এই খাবারের কারো মুখে যাতে কোন দুর্গন্ধ তৈরি হতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। এর জন্য চাই সঠিক সময়ে সঠিক নিয়মে দাঁত ও মুখের পরিচর্যা।
রমজান মাস প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর সিয়াম সাধনার মাস। রোজার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উন্নতি ও আত্মার পরিশুদ্ধি এবং আল্লাহ ভীতি অর্জিত হয়। এই মাসে খাবার গ্রহণের মধ্যে যেমন ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়, তেমনি মুখ ও দাঁতের যতœও কিছুটা ভিন্ন সময়ে করতে হয়। সাধারণ নিয়ামানুযারী সকালে নাস্তার পর এবং রাতে খাবারের পর আমরা দাঁত ব্রাশ করি। কিন্তু এই পবিত্র মাসে সেহরির পর ভোররাতে এবং রাতে ঘুমাবার আগে টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে হয়। দাঁত হতে ছোট কোন জিনিস (ছোলা, মাংস) বের করে চিবিয়ে খেলে রোজা মাকরুহ হয়ে যায়। তাই ভোর রাতে সেহরির পর ব্রাশ যেসব জায়গা পরিষ্কার করতে পারে না, বিশেষ করে দুই দাঁতের মাঝখানে সেসব জায়গায় ডেন্টাল ফ্লস (সোম মিশ্রিত দাঁতের সুতা) ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া মাউথওয়াস দ্বারা জোরে জোরে কুলকুচি করা উত্তম। অনেকে আবার ইফতারী করার পূর্বে টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করেন কিন্তু এতে যেমনি রোজা মাকরুহ হয় তেমনি এর কোন প্রয়োজন নেই। তবে আপনি ইচ্ছা করলে রোজা থাকা অবস্থায়ও মেছওয়াক (নিম গাছের ডাল দিয়ে তৈরি) করতে পারেন মেছওয়াক করা সুন্নত। আমাদের নবী কারীম (সা.) মেছওয়াক করতেন এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হলো এটি নিম গাছের ডাল দিয়ে তৈরি এবং এতে প্রচুর প্রাকৃতিক ফ্লোরাইড রয়েছে যা কি না দাঁতের যতেœ অত্যন্ত কার্যকরী এবং দন্তক্ষয় প্রতিরোধ করে। রোজাদারগণ প্রত্যেকেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পূর্বে মুখ ও দাঁত পরিষ্কারের জন্য মনের দিক থেকে তাগিদ অনুভব করেন। সুতরাং প্রতিবার নামাজের পূর্বে মেছওয়াকের সাথে সাথে মাঢ়ি হাতের আঙ্গুল দ্বারা ম্যাসেজ করলে মাঢ়ির রক্ত সঞ্চালন ঠিক থাকে। তবে রোজা রেখে গরগরা করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ এতে রোজা মাকরুহ হয়ে যায়, তবে হালকা কুলকুচি করতে পারেন। অনেকে আবার রোজার মধ্যে ধাতব খিলাল ব্যবহার করেন যা রুপার বা তামার তৈরি। কিন্তু এগুলো মাঢ়ির মধ্যস্থ নরম কোষগুলোকে আঘাত প্রাপ্ত করে। ফলে রক্তক্ষরণ হয়ে মাড়িতে ইনফেকশন হতে পারে। তাই ধাতব খিলাল ব্যবহার করা উচিত নয়।
যেহেতু সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যডোবা পর্যন্ত কোন খাবার বা পানীয় খাওয়া যাবে না, তাই তখন মুখের ভেতর লালা নিঃসরণ কম হবে। মুখ গহ্বরের সুস্বাস্থ্যের জন্য লালার কার্যকারিতা রয়েছে। লালা মুখ গহ্বরের নরম টিস্যু বা কলাকে ভেজা, পরিষ্কার ও পিচ্ছিল রেখে এন্টিব্যাকটেরিয়াল পরিবেশের মাধ্যমে মুখ গহ্বরের আবরণ এবং দাঁত ও মাঢ়িকে বিভিন্নভাবে রক্ষা করে। মুখের ভেতর লালা নিঃসরণ কম হলে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া রয়েছে, যা সহজেই সক্রিয় হয়ে উঠে এবং প্রথমে প্লাক ও পরে দন্ত ক্ষয়ের সৃষ্টি করবে। সুতরাং এই পবিত্র মাস যেমনি ধৈর্যের মাস, ধৈর্য সহকারে যেমন পানাহার পরিত্যাগ করতে হয় তেমনি মুখ ও মুখ গহ্বর এবং দাঁত পরিষ্কার করতে হবে। আপনার মুখ ও দাঁতের যতœ যদি এই একটি মাস ঠিকমতো না নেন তাহলে সহজেই মুখ গহ্বরের রোগে আক্রান্ত হবেন। তাই ইফতারের সময় প্রচুর পানি পান করা উচিত যাতে মুখ গহ্বরের স্বাভাবিক লালা নিঃসরণ প্রক্রিয়া চালু থাকে এবং প্লাক সহজে দূরীভূত হয়।
ইফতারের সময় ভাজা ও শক্ত খাদ্যদ্রব্য তালিকায় কম রেখে ভিটামিনযুক্ত সবজি ও ফলমূল এবং ফলের রস রাখা উচিত। এর ফলে কোষ্ঠ্যকাঠিন্যদূর হবে এবং সেই সাথে মুখের দুর্গন্ধও হবে না। তবে শরবতে চিনি কম দেয়া উচিত দন্তক্ষয় রোধ করার জন্য। সবশেষে বলতে চাই, রোজা রাখার জন্য যেমনি সুস্থ, পবিত্র, নিরোগ কাম্য তেমনি নির্মল মুখ ও মুখ গহ্বরের জন্য দাঁতের যতœ প্রয়োজন।
ষ ডা. তানিয়া নাসরীন
দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন