বাংলাদেশ রেলওয়ে বগি ও ইঞ্জিন স্বল্পতা নিয়ে, নানাবিধ বিশৃঙ্খলা ও সিডিউল বিপর্যয় নিয়ে চলছে দীর্ঘদিন ধরে। রেলের আধুনিকায়ন ও সময়োপযোগী উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ২৭০টি কোচ এবং ৭০টি লোকোমোটিভ রেলে যুক্ত করার উদ্যোগ এখন বাস্তবায়নাধীন। প্রথম দফায় ইন্দোনেশিয়া থেকে আনা ১৫টি বগি রেলে যুক্ত হয়েছে বলে জানা যায়। নতুন আমদানি করা বগিকে লাল-সবুজ রঙে রাঙিয়ে গত ২৫ জুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে নতুন আন্তঃনগর ট্রেন সোনার বাংলা উদ্বোধন করেছেন সাড়ম্ভরে। নবসংযোজিত এই এক্সপ্রেস ট্রেনের আভ্যন্তরীণ ডেকোরেশন এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথেষ্ট উচ্ছসিত দেখা গেছে। তবে বিস্ময় দেখা দিয়েছে ভিন্ন প্রশ্নে। শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে রেলকোচগুলো আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভারত থেকে আমদানি করার পর বাংলাদেশ রেলওয়েতে সংযোজিত ও চলাচল শুরুর পর দেখা যাচ্ছে, এসব কোচের দরজায়, ফ্যানে এবং ইঞ্জিনের বাইরে ‘ইন্ডিয়ান রেলওয়ে’ এবং হিন্দি ভাষায় লেখা। ভারতের জন্য ভারতে তৈরি রেলকোচে হিন্দি লেখা থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে এগুলো ভারতীয় রেলওয়ের জন্য তৈরি বা পরিত্যক্ত মাল নয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য বিশেষভাবে তৈরি। এসব কোচ এবং বগি কিনতে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতামূলক মূল্যের চেয়ে বেশী মূল্য দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। যেখানে প্রযুক্তিগত সুবিধা, সেবার মান ও গতির দিক থেকে সারাবিশ্বেই রেলযোগাযোগ নতুন নতুন বিস্ময়কর রেকর্ডের জন্ম দিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও গতি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা ইঞ্জিন বগিতে সজ্জিত সদ্য উদ্বোধন করা আন্তঃনগর ট্রেন সোনার বাংলার রানিং টাইম ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের পুরনো সুবর্ণ এক্সপ্রেসের চেয়েও কম বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে বাংলাদেশের রেলযোগাযোগ ব্যবস্থার একমাত্র জাতীয় বা সরকারী সংস্থা। এ কারণেই রেলওয়েকে তার পুরনো রেড অক্সাইড রং বদলে নতুনভাবে জাতীয় পতাকার লাল-সবুজ রঙে সাজানো হয়েছে। এই জাতীয় সংস্থার জন্য যেখান থেকেই ইঞ্জিন, বগি অথবা যে কোন সামগ্রী কেনা হোক, তাতে অবশ্যই বাংলাদেশ রেলওয়ের লোগো সম্বলিত মনোগ্রাম এবং বাংলায় লেখা থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজী লেখা থাকাও আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য। যে দেশ থেকেই আমদানি করা হোক না কেন, বাংলাদেশ বিমানের গায়ে এবং বিমানের ব্যবহার্য সব সামগ্রীতেই ‘বাংলাদেশ বিমান’ এবং বালাদেশ এয়ারলাইন্স বাংলায় ও ইংরেজীতে লেখা থাকে। অতীতেও ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে রেলওয়ের জন্য লোকোমোটিভ ও বগি কেনা হয়েছে। রেলের বগিতে ভিন্ন কোন দেশের নাম বা যে দেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে সে দেশের ভাষা ব্যবহারের কথা শোনা যায়নি। রেলের চলতি প্রকল্পেও ভারতের পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া থেকে কোচ আনা হলেও সেখানে কোন ব্যত্যয় দেখা যায়নি। শুধুমাত্র ভারত থেকে আমদানি করা কোচে ইন্ডিয়ান রেলওয়ে এবং হিন্দি লেখা লেখা রয়েছে এ রকম কোচ পাঠানোর বাস্তবতায় দেশবাসী বিস্মিত, হতবাক। রেলে চলাচলকারী সচেতন যাত্রিরা এখন প্রশ্ন করছেন, ভারতীয় রফতানীকারকরা কি এখন বাংলাদেশ রেলওয়েকে ভারতীয় রেলওয়ের অংশ মনে করেন, অথবা তারা বাংলাদেশকে আলাদা দেশ মনে করেন না? ভারতীয়রা যাই মনে করুক, বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিষয়টিতে কিভাবে রি-অ্যাক্ট করছেন সেটাই আমাদের কাছে প্রধান বিবেচ্য। ভারত থেকে আমদানি করার পর রেলের সামগ্রীগুলোকে ২ মাস ধরে সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপে সংস্কার করা হয়েছে বলে জানা যায়। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে’তে ‘ইন্ডিয়ান রেলওয়ে’ এবং হিন্দি ভাষার লেখাগুলো মুছে ফেলা হয়নি কেন এমন প্রশ্নের কোন সন্তোষজনক জবাব রেলের সংশ্লিষ্টরা দিতে পারেননি।
যে দেশের মানুষ মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বুকে রক্ত ঢেলে দিয়ে অন্যান্য নজির স্থাপন করেছে। যে দেশের মানুষ জাতিগত স্বাতন্ত্র্য ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করে প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সে দেশের রেলওয়ের বগিতে ভারতীয় রেলওয়ের নাম এবং হিন্দি ভাষায় লেখা থাকার ঘটনাকে নিছক ভুল, অনবধান বলে মেনে নেয়া যায় না। বর্তমান সরকার সব সময় নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার বলে দাবী করছে। দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি ভারতের বেলায় আপোসযোগ্য? দেশের মানুষ ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার। ভারতীয় পণ্যের অবাধ অনুপ্রবেশের কারণে দেশীয় শিল্প মার খাচ্ছে। আমাদের বৈদেশিক রেমিটেন্সের এক বিরাট অংশ এখন নানাভাবে ভারতে চলে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে দেশের মানুষ নিস্পৃহ নয়। তবে সরকারের ভেতরে এবং বিভিন্ন সংস্থায় ঘাপটি মেরে থাকা একটি শ্রেণী ভারতীয় সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসনের পক্ষে কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে। তারা আমাদের ভাষা ও স্বাধীনতার গৌরব ও আত্মমর্যাদাবোধের উপর আঘাত হানছে। যে দল এবং যে নেতার নেতৃত্বে আমরা একাত্তরে এক সমুদ্ররক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, এখন সেই দল এবং সেই মহান নেতার উত্তরসুরি বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায়। জাতীয় পতাকার রঙে সজ্জিত বাংলাদেশ রেলওয়ের কোচের ভেতর ‘ভারতীয় রেলওয়ে’ এবং হিন্দি লেখা অক্ষুণœ রাখা একটি অমার্জনীয় অপরাধ। এ জন্য রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত। রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করা উচিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন