তুরস্কের ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলায় অন্তত ৪২ জন নিহত ও প্রায় ২৫০ জন আহত হয়েছেন। ইসলামিক স্টেট (আইএস) মঙ্গলবার মধ্যরাতে এ হামলা চালিয়েছে বলে তুরস্ক সরকার ধারণা করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ‘যৌথ প্রতিরোধের’ আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তাঁর দেশের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) প্রধান জন ব্রেনানও এ হামলার জন্য আইএসের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। ওবামাসহ বিশ্বনেতারা ঘটনার নিন্দা করে তুরস্ককে সহানুভূতি জানিয়েছেন। গত বুধবার রাত পর্যন্ত এ হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেনি কেউ। হামলার পর এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, ‘যদি রাষ্ট্রগুলো তাদের মানবিক দায়িত্ববোধ থেকে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ না নেয়, তবে আমাদের মনের ভেতরে থাকা আশঙ্কাগুলো একে একে বাস্তবে রূপ নেবে।’ তিনি আরও বলেছেন, বিশ্বজুড়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই হামলা ক্রান্তিলগ্ন হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। আজ ইস্তাম্বুলে বোমা হামলা হয়েছে, আগামী দিনে বিশ্বের যে কোনো শহরের যে কোনো বিমানবন্দরে এ ধরনের হামলা হতে পারে। তুরস্কের প্রধান মন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম বলেছেন, এই হামলার পেছনে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ, হামলার ধরন ও গতি প্রকৃতি আইএসের দিকে ইঙ্গিত করে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২৮ জন তুরস্কের নাগরিক। ৫ জন সউদি আরবের ও ২ জন ইরাকের নাগরিক। এছাড়া চীন, জর্ডান, তিউনিসিয়া, ইরান, ইউক্রেন ও উজবেকিস্তানের ১ জন করে নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। এই বছরে তুরস্কে বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী হামলায় কমপক্ষে ১৩২ জন নিহত হয়েছে। ১২ জুন সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় হামলায় ১২ জন জার্মান নিহত হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারী আঙ্কারায় সামরিক এলাকায় হামলায় ২৯ জন নিহত হয়। কুর্দি বিদ্রোহীরা হামলার দায়িত্ব স্বীকার করে। ১৩ মার্চ আঙ্কারায় গাড়িবোমা হামলায় ৩৫ জন মারা যায়। কুর্দি বিদ্রোহীরা এই হামলার দায় স্বীকার করে। ১৯ মার্চ ইস্তাম্বুলে আইএসের আত্মঘাতী হামলায় নিহত হয় ৪ জন। ৭ জুন ইস্তাম্বুলে কুর্দি বিদ্রোহীদের গাড়িবোমা হামলায় পুলিশের ৭ সদস্যসহ ১১ জন নিহত হয়। ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তুরস্কের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর। এটি ইউরোপের তৃতীয় এবং বিশ্বের ১১তম ব্যস্ত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। দেশী-বিদেশী যে ৪২ জন নিহত হয়েছেন তাদের বিদ্রোহী আত্মার প্রতি মাগফিরাত কামনা করছি। যে ২৫০ জন আহত হয়েছেন তাদের প্রতি এবং তাদের পরিবারের প্রতি জানাচ্ছি গভীর সমবেদনা। যারা এই নারকীয় হামলা চালিয়েছে তাদের প্রতি জানাই তীব্র ধিক্কার এবং নিন্দা। এখন পর্যন্ত এটি স্পষ্ট হয়নি যে, কারা এই হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন যে, এই হামলা ইসলামী স্টেট করেছে বলে বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে। যারাই এই হামলা করে থাকুক না কেন তারা পৃথিবীর অত্যন্ত নিন্দীয় অপরাধ করেছে। তারা এমন একটি মুসলিম দেশের ওপর হামলা করেছে যে দেশটি একদিকে ইউরোপের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে উত্থিত হচ্ছে, অন্যদিকে মুসলিম জাহানে ক্রমশ নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করছে। বিশ্ব রাজনীতিতে তুরস্ক আজ স্পষ্টবাদী দেশ হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, তুরস্কের অপর নাম ইউরেশিয়া। কারণ তুরস্কই সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র দেশ যার একাংশ ইউরোপে এবং অপরাংশ এশিয়ায় অবস্থিত। যে দেশটি এক সময় ওসমানীয় সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব দিয়েছে সেই দেশটি থেকে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ইসলাম এবং মুসলমানিত্বকে নির্বংশ করে ছিলেন। তার পর থেকে তুরস্ক পশ্চিমা ধারার জীবন-যাপন, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে অভস্ত হয়। চলতি শতক থেকে এরদোগানের জাস্টিজ পার্টি সেই তুরস্কে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেই তুরস্কে আজ ইসলামী শাসন চালু হয়েছে এমন দাবি করা যাবে না। তবে ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে তুরস্ক ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিগত কয়েক দশক ধরে তুরস্ককে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পদলেহি করা হয়েছিলো। জাস্টিজ পার্টি তুরস্কের ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন প্রভাব বলয় থেকে তুরস্ক ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এমন একটি পটভূমিতে তুরস্কের ওপর বার বার আঘাত হানা হচ্ছে।
তুরস্ক ইউরোপ আমেরিকার মতো ধনাঢ্য দেশ নয়। তারপরেও সিরিয়ায় বিদেশী হামলার পর প্রায় অর্ধকোটি লোক নিজ দেশ থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন দেশে শরনার্থী হয়। এসব শরনার্থীর দুই তৃতীয়াংশকেই গ্রহণ করেছে তুরস্ক। মুসলিম জাহানে জঙ্গিবাদ দমন করার জন্য সউদি আরবের নেতৃত্বে যে জোট গঠন করা হয়েছে সেখানেও যোগদান করেছে তুরস্ক। আফগানিস্তান, ইরাক এবং সিরিয়ায় যে বিদেশী হামলা হয়েছে এবং হচ্ছে তার বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে তুরস্ক। যে অশুভ শক্তি ইরাক, আফগানিস্তান এবং সিরিয়াকে খ--বিখ- করতে চায় তাদের বিরুদ্ধেও বলিষ্ঠ বক্তব্য দিয়েছেন এরদোগান। সেই একই অশুভ শক্তি ইরাক, আফগানিস্তান এবং সিরিয়া ছাড়াও তাদের বদ নজর দিয়েছে পাকিস্তান এবং ইরানের প্রতি। মুসলিম জাহানের ঐক্য ও সংহতির পক্ষে কাজ করার জন্য আজ যদি সেই অশুভ শক্তি তুরস্ককেও নাস্তানাবুদ করতে চায় এবং সেই বদ মতলবে তুরস্কের ওপর বার বার তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে দন্ত-নখর বসায় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এমন একটি পটভূমিতে আজ সময় এসেছে, সমগ্র মুসলিম জাহান এবং গণতান্ত্রিক বিশ্ব এই দুর্যোগে তুরস্কের পাশে দাঁড়ানোর। বাংলাদেশও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে। তাই জনগণ আশা করে, তুরস্কের এই কঠিন সময়ে বাংলাদেশও তুরস্কের পাশে দাঁড়াবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন