হজরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) এর ওফাত বার্ষিকী বাংলাদেশে এবার অনেকটা নীরবেই অতিবাহিত হয়ে গেছে। তাতে পীরানে পীর দস্তগীর হজরত গাওসুল আজম আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) এর শান ও উঁচু মর্যাদা ক্ষুণœ হবার কিছু নেই। তবে বাস্তব সত্য হচ্ছে, হজরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) ছিলেন এমন এক আধ্যাত্মিক সাধক যাঁর স্মরণ করা বিশেষ সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তেই তাঁর মহান আদর্শ শিক্ষার অনুসরণ-অনুকরণ করে নিজেকে উত্তম চরিত্রের অধিকারী করা যায়। তিনি সারা বছর স্মরণযোগ্য মহান ব্যক্তিত্ব।
আওলিয়া ও মাশায়েখে কেরামের মধ্যে হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) সর্বোচ্চ মর্যাদা-সম্মানের অধিকারী ছিলেন প্রধাণত দু’টি কারণে। প্রথমত, তিনি আহলে বায়তের কামেল আওলিয়া ও হাসানাইন সৈয়দগণের একজন। অর্থাৎ তিনি পিতা ও মাতা উভয় দিক থেকে ছিলেন ‘নাজিবুত তরফাইন’ অতি উচ্চ সম্মানী বংশের। তিনি আবদুল্লাহ মহয ইবনে হাসান মোছাল্লা ইবনে হাসালি ইবনে আলী মোর্তাজা (রা.) এর বংশধর এবং মাতার দিক থেকে ছিলেন হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এর বংশধর। এভাবে তাঁর বংশধারা আহলে বায়ত বা রসূল ঘরানার সাথে মিলে যায়। বংশ মর্যাদাগত শ্রেষ্ঠত্ব ও বৈশিষ্ট্য তাঁকে সকলের ভক্তি সম্মানের একক পাত্রে গণ্য করে এবং হজরত ইমাম হাসান (রা.) ও ইমাম হোসাইন (রা.) এর যাবতীয় গুণাবলীর তিনি অধিকারী হয়ে ছিলেন। দ্বিতীয়ত, হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) খোদা প্রদত্ত মেধা, প্রতিভা ও জ্ঞান সাধনে জাহেরী ও বাতেনী জ্ঞান লাভ করে শরীয়ত ও মারফতের যে উচ্চ ‘মাকাম’ অর্জন করেছিলেন তা সকলকে অতিক্রম করে গিয়েছিল। হজরত পীরানে পীর গাওসুল আজম (রহ.) এর সীরাত লেখকদের বর্ণনা হতে জানা যায় যে, তিনি সরাসরি হুজুর (সা.) ও হজরত আলী (রা.) এর ফয়েজ লাভ করেছিলেন। এ সম্পর্কে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে।
তাসাওফ সাধক মুফতী মোহাদ্দেস, ফকীহ এবং ক্বারী আবু সাঈদ মাখজুমীর নিকট তরিকতে মুরীদ হবার পর অনেক দিন তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেন হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)। পীরের মাদ্রাসায় অবস্থানকালে তিনি এক দুপুরে হুজুর (সা.) কে স্বপ্নে দেখেন এবং তাকে বলেন, ‘আব্দুল কাদের! তুমি ওয়াজ নসিহত করনা কেন?’ তিনি আরজ করলেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি একজন আমী (অনারব), আরবের ভাষাবিদদের সামনে কীভাবে জবান খুলব?’ রসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তোমার মুখ খুলো।’ তিনি নির্দেশ পালন করলেন। হুজুর বললেন, ‘এবার তোমার কওমের কাছে গিয়ে তাদেরকে আল্লাহর পথে আহŸান কর।’ এটি হিজরী ৬২১ সালের ১৪ শাওয়ালের ঘটনা।
হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) বলেন, এ স্বপ্নের পর আমি জোহরের নামাজের পর ওয়াজ করার জন্য বসে পড়ি। আশে-পাশে কিছু লোকও সমবেত হয়। জীবনে প্রথম ওয়াজ, ঘাবড়ে যাওয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক। সে সময় হঠাৎ কাশফের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং দেখলাম, শাহে কেনায়েত আমিরুল মোমেনীন হজরত আলী (রা.) আমার পাশে দাঁড়িয়ে। তিনি আমাকে বললেন, ‘আবদুল কাদের! কেন ওয়াজ বল না?’ বললাম, ‘ভয় পাই, ঘাবড়ে যাই।’ তিনি বললেন, ‘মুখ খুলো।’ নির্দেশ পালন করলাম। তিনি ৬ বার তাঁর লোআব আমার মুখে ঢেলে দেন এবং আমি আরজ করলাম, ‘লোআব সাতবার কেন প্রদান করলেন না?’ তিনি বললেন, এটা হুজুর (সা.) এর প্রতি আদব ও সম্মান প্রদর্শন।
এ ঘটনার পর শায়খ জিলানী (রহ.) এর মধ্যে ওয়াজ-নসিহতের যে অনলবর্ষীধারা শুরু হয়ে যায় তা ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। তাঁর ওয়াজে মুগ্ধ হয়ে তাঁর হাতে পাঁচ হাজারের অধিক ইহুদী-খ্রিস্টান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল বলে বর্ণিত হয়ে থাকে। তাঁর ওয়াজের আসর ও প্রভাব সম্পর্কে অসংখ্য কাহিনী রয়েছে, যা বলে শেষ করা যাবে না।
হজরত গাওসুল আজম (রহ.) এর ব্যাপক জনপ্রিয়তার একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র বর্ণিত বিবরণে ফুটে উঠেছে। কারামত বা অলৌকিক ঘটনা তাকে যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে তা বাস্তবিকই অনন্য সাধারণ। এতদ্ব্যতীত তাগুতী শক্তি, শয়তানের প্রতারণার শিকার হয়েছেন অনেক সাধক বুজর্গ, কিন্তু হজরত গাওসুল আজম (রহ.) এর সাথে প্রতারণা করতে এসে শয়তান কী নির্মম ও শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল, তা এক স্মরণীয় ঘটনা। শয়তান নিজেই হতাশ হয়ে বলেছিল যে, ইতিপূর্বে সে সত্তর জন আল্লাহর অলীকে গুমরাহ করতে সক্ষম হয়েছিল, বড় পীর সাহেবের কাছে সে হেরে গেছে।
হজরত গাউসুল আজম বড় পীর আবদুল কাদের জীলানী (রহ.) ছিলেন বহুমুখী কারামত বা অলৌকিক ঘটনাবলীর অধিকারী মহান আধ্যাত্মিক সাধক। বিখ্যাত কাদেরিয়া তরিকার প্রবর্তক, সাধন জগতের এই শিরোমনির পবিত্র জীবন কাহিনীর অসংখ্য চমকপ্রদ ঘটনায় পূর্ণ, তারই একটি হলো, ইবলিশ শয়তানের বারে বারে হামলা হতে রক্ষা পাওয়া এবং তাকে চরমভাবে পরাভ‚ত করা। বিভিন্ন জীবনী গ্রন্থে ঘটনাটি এইভাবে বর্ণিত হয়েছে: শেখ হাম্মদ আদ্দাসার সাথে সাক্ষাতের পর হজরত আবদুল কাদের জীলানী (রহ.) বাগদাদের ‘কার্খ’ নামক একটি অনাবাদী মহল্লায় এগার বছর চিল্লা করেন। এ সময় তাঁর এমন করুণ অবস্থা হয়েছিল যে, একবার চিকিৎসকগণ তাকে মৃত ঘোষণা করেন এবং তাঁর কাফন-দাফনের ব্যবস্থাও হতে থাকে। হঠাৎ তিনি আওয়াজ করতে থাকেন। লোকেরা তখন তাকে ‘আজব দেওয়ান’ বলে আখ্যায়িত করতে থাকে।
এক সময়ের কথা, একদিন তিনি বাগদাদ হতে বের হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বহুদূর চলে যান। যখন তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে, তখন বুঝতে পারলেন যে, তিনি ‘শম্ভর’ নামক এলাকায় অবস্থান করছেন, যা বাগদাদ হতে প্রায় বারো দিনের দূরত্বে অবস্থিত। তিনি নিজের এ অবস্থা দেখে খুবই তাজ্জব বনে যান। এ সময় এক নারী সে পথে যাচ্ছিল এবং চুপে চুপে বলছিল, ‘তুমি আবদুল কাদের হয়ে তাজ্জব বনে গেছ?’ এটি ছিল তার মোশা জগতের প্রথম অভিব্যক্তি।
অতঃপর সময়ের সাথে শয়তানও তার পিছু নেয়, শয়তান ভয়ানক রূপ ধারণ করে অগ্নি সজ্জিত হয়ে তার ওপর হামলা চালায়। তার কানে গায়বী আওয়াজ ধ্বনিত হয়, ‘আবদুল কাদের! ওঠো এবং তার মোকাবিলা কর। তোমার সাথে আমাদের সাহায্য রয়েছে।’ তিনি শয়তানের মোকাবিলা করতে এবং ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা’ বলে হুঙ্কার মারতেন, এতে শয়াতন আগুনে পুড়ে ভস্ব হয়ে যেতো। এ ঘটনার পরও শয়তানের হামলা থেমে যায়নি, শয়তান কুৎসিত বিকৃত রূপে হজরত আবদুল কাদের (রহ.) এর নিকট আসে, তার শরীর হতে ভীষণ দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। শয়তান বলে, ‘তুমি আামকে এবং আমার শিষ্যবৃন্দকে দুর্বল করে দিয়েছ। এখন আমার বাসনা, তোমার সেবা করা।’ তিনি বললেন, ‘হে অভিশপ্ত! তুই এখান থেকে দূর হয়ে যা।’ এ সময় একটি গায়বী হাত তার মাথার ওপর, মুখে এবং জমিনে ধসে যায়।
অতঃপর তৃতীয়বার মরদূদ শয়তান তার নিকট আসে। এবার তার হাতে ছিল আগুনের গোলা। শয়তান তার ওপর হামলা চালায়। তখন মুখোশ পরিহিত এক ঘোড়সওয়ার এসে হজরত আবদুল কাদের জীলানী (রহ.)কে একখানা তরবারি প্রদান করেন। তরবারিখানা দেখা মাত্র শয়তান পলায়ন করে। এরপর আরো একবার তিনি শয়তানকে এমন অবস্থায় দেখেন যে, সে জমিনে বসে মাথায় মাটি মেখে আহাজারি করছে এবং তাকে দেখে বলতে থাকে, ‘আবদুল কাদের আমাকে নিরাশ করেছে।’ তিনি বললেন, ‘হে মালউন-অভিশপ্ত! আমি তোর কাছ থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি, আউজুবিল্লাহিমিনাশ শায়তানির রাজীম।’ শয়তান বলল, ‘এ বাক্যটি আমার জন্য অনেক কষ্টদায়ক।’ অতঃপর শয়তান তাঁর আশে-পাশে জাল বিস্তার করে এবং ফাঁদ বসিয়ে বলে, ‘এটি দুনিয়ার জাল, যা আমি তোমার মতো লোকদের আশে-পাশে বিস্তার করে থাকি।
হজরত আবদুল কাদের জীলানী (রহ.) এ পরিস্থিতির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং এক বছর পর্যন্ত এরূপ ফাঁদ ধ্বংস করতে থাকেন। কিন্তু শয়তানের সবচে মারাত্মক হামলাটি খুবই বিস্ময়করভাবে আবির্ভূত হয়। তিনি প্রত্যক্ষ করলেন যে, এক বিশাল আলো, যা দ্বারা সমগ্র আসমান আলোকিত দেখা যায়। সেখান থেকে একটি আকার প্রকাশ পায়। আকারটি তাকে সম্বোধন করে বলে, ‘হে আবদুল কাদের! আমি তোমার খোদা, তোমার জন্য আমি সমস্ত কিছু হালাল করে দিয়েছি।’ তিনি এ দৃশ্য দেখে ‘আউজুবিল্লাহ’ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে আলোকমালা গভীর অন্ধকার হয়ে ধোঁওয়াতে পরিণত হয়ে যায় এবং সেখান হতে আওয়াজ আসে, ‘হে আবদুল কাদের! তোমার ইলম ও ফেকাহ তোমাকে আমার প্রতারণা হতে রক্ষা করেছে, আমি এ ফাঁদ ফেলে সত্তর জন আওলিয়াকে গোমরাহ করেছি।’ তিনি বললেন, ‘এ সব কিছু আমার মাওলার ফজল ও করম যা তিনি আমাকে দান করেছেন।’ কিছুদিন পর তাকে প্রশ্ন করা হলো, ‘আপনি কীভাবে জানলেন সে শয়তান ছিল?’ তিনি বললেন, ‘তাঁর এই উক্তি সকল হারাম বস্তু আমি তোমার জন্য হালাল করে দিয়েছি।’ এ ঘটনায় সকলের জন্য রয়েছে অনন্ত শিক্ষা ‘ফাতাবিরু ইয়াওলিল আলবাব।’ (জ্ঞানীদের জন্য এতে রয়েছে শিক্ষনীয় বিষয়)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন