রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকা গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের ৬ জন অপারেশন থান্ডারবোল্ট পরিচালনার সময় নিহত হয়েছে। একজন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের সবাই বাংলাদেশী এবং বয়স ২৫ থেকে ৩০-এর মধ্যে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংঘটিত এ ধরনের অনেক সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনায় বিদেশীদের সম্পৃক্ততা ধরা পড়েছে। বাংলাদেশে এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ও বিপুল প্রাণহানিকর ওই সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে বাংলাদেশীদেরই দ্বারা এবং যারা বয়সে তরুণ। তারা সম্ভবত দেশেই সন্ত্রাসী আদর্শ ও ধ্যান-ধারণায় অনুপ্রাণিত ও দীক্ষিত হয়েছে। তাদের রাজনৈতিক পরিচয় নেই। দলীয় কোনো পরিচিতিও নেই। তারা আসলে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী। প্রশ্ন উঠতে পারে, কারা তাদের বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করেছে? যারাই করুক, তারা যে বাংলাদেশের মিত্র নয়, তরুণদের হিতৈষী নয়, ধর্মের প্রকৃত অনুসারী নয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা তরুণদের মধ্যে ভ্রান্ত নীতি-আদর্শ প্রচার করছে, উগ্রতা, ধর্মান্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে, যার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ধর্ম হিসেবে ইসলাম সবচেয়ে মানবমুখী, সবচেয়ে মানব কল্যাণকামী, সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক। ইসলামে সন্ত্রাস, হানাহানি, উগ্রতা, সহিংসতা ও নিরীহ মানুষ হত্যার কোনো স্থান নেই। আশ্চর্য ও বিস্ময়ের বিষয় এই যে, বিশ্বের দেশে দেশে এই ইসলামের নাম করেই বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে আইএস, আল-কায়েদা, আল-শাবাব প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়। ইসলামের নামে গড়ে উঠলেও এসব সংগঠন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে ইসলামেরই। প্রধানত মুসলমানরাই তাদের সন্ত্রাস ও হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছে। অন্যদিকে তাদের হামলা ও হত্যাকা-ের কারণে বিশ্বের অমুসলিমরা ঢালাওভাবে মুসলমানদের দায়ী করছে। এর খেসারত হিসেবে মুসলমানরা হামলা, হত্যা, নির্যাতন, বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। ইসলামের নামে গড়ে ওঠা সন্ত্রাসবাদী, উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর ধ্যান-ধারণা ও আদর্শ বাংলাদেশে এসে যাওয়া অসম্ভব নয়। এসেছে যে, এমন প্রমাণ নানা ঘটনায় পাওয়া গেছে বা যাচ্ছে। সাম্প্রতিককালে বিদেশীসহ অধ্যাপক, প্রকাশক, ব্লগার ও বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের ওপর হামলার কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব হামলায় অন্তত ৫০ জন নিহত হয়েছে। গুলশানের রেস্টুরেন্টে হামলার ঘটনায় দু’জন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জন নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে বিদেশীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি।
এ ধরনের একক বা গণহত্যায় মানুষের মধ্যে ভীতি ও সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যটিই কেবল অর্জিত হয়। অন্য কোনো লাভ হয় না। সন্ত্রাস ও হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে কোথাও ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এটা ইসলামের পথ নয়, বিপথ। বিশ্বজুড়ে ইসলামের নামে যে সন্ত্রাস ও হত্যাকা- চলছে তার বহুমুখী বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা কারো অজানা নেই। এটাও লক্ষ্যযোগ্য, বিশ্বের কোথাও সাধারণ ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা- সমর্থন করে না। তারাই এসব অপরাধ ও অপকর্মের সবচেয়ে কড়া প্রতিবাদী ও সমালোচক। দুঃখজনক হলেও স্বীকার্য বিপথগামীদের অপরাধ ও অপকর্মের দায় নানাভাবে বিশ্ব মুসলিমকেই পরিশোধ করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃতিগতভাবে নরম, নিরীহ ও ধর্মপ্রাণ। তাদের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রবাদ স্থান পাওয়ার কথা নয়। তারপরও সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা উপর্যুপরি ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এতে বোঝা যায়, ব্যতিক্রম হলেও উগ্রবাদের বিস্তার ও সম্প্রসারণ ঘটছে। এর পেছনে বাইরের প্রভাব নিয়ামক ভূমিকা রাখছে বলেই মনে হয়। এটা খুবই উদ্বেগ ও বিচলনের বিষয়। বাংলাদেশ মডারেট মুসলিম কান্ট্রির যে বিশেষ পরিচয় বহন করে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে প্রশংসিত হয়, এসব সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা সেই পরিচয়কে মসীলিপ্ত করছে, অবনমিত করছে। কাজেই যেকোনো ব্যবস্থার এই উগ্রবাদজাত সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা- বন্ধ করতে হবে। শান্তি-শৃঙ্খলা, নাগরিক নিরাপত্তা এবং জাতীয় উন্নয়ন-অগ্রগতির স্বার্থেই এটা করতে হবে।
সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে কোনো বিদেশী না থাকার প্রেক্ষাপটে স্বস্তির কোনো সুযোগ নেই। কারণ, সন্ত্রাসী বহিরাগতই হোক, বা হোম গ্রোনই হোক, তাতে কোনো ফারাক নেই। তাদের অপরাধ ও অপকর্মের ফলাফল অভিন্ন। গুলশানের রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা বাংলাদেশে নজিরবিহীন। হামলাকারী সন্ত্রাসীরা তাদের করুণ পরিণতির কথা জেনেই ওই হামলা ও হত্যাকা- ঘটিয়েছে এবং পরিণতিও ভোগ করেছে। নীতি-আদর্শ, দর্শন প্রতিষ্ঠায় ত্যাগ, সাধনা ও জীবনদানের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। কিন্তু এ ধরনের সন্ত্রাসীদের আত্মঘাতীপ্রবণ হয়ে ওঠার পেছনে মহৎ কোনো লক্ষ্য নেই, যদিও এটা তারা জানে না। এই বিভ্রান্ত ও বিপথগামী তরুণরা আমাদের অপর নয়। তাদের বিভ্রান্তি মোচন করে সৎ পথে ফিরিয়ে আনা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাদের হত্যা করা কোনো সমাধান নয়। কারণ, একজনকে হত্যা করা হলে তার জায়গায় আরেকজন আসবে। সন্ত্রাসী মরবে কিন্তু সন্ত্রাস বন্ধ হবে না। সন্ত্রাসী হত্যা নয়, বরং তাদের ভ্রান্ত নীতি-আদর্শ ও মতবাদকে হত্যা করাই এই সঙ্কট সমাধানের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। এ জন্য ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা তরুণদের মধ্যে বিস্তার ঘটাতে হবে। পাঠ্যক্রমে ইসলামের আদর্শ, নীতিবোধ ও মূল্যবোধ সম্বলিত বিষয় ব্যাপকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। দেশের আলেম-ওলামা, মসজিদের ইমাম এবং সচেতন-শিক্ষিত ধর্মপ্রাণ মানুষ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নৈতিক ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষক সমাজ ও অভিভাবক মহলকে এ ব্যাপারে আরো সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। এভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা আমাদের তরুণদের বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারি। একই সঙ্গে সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন