একলাছ হক : ঈদ মানে আনন্দ। ঈদ মানে খুশি। চিরাচরিত এই উক্তি সর্বজনীন স্বীকৃত। কিন্তু ঈদেও যাদের আনন্দ নেই, তারা আর কেউ নয়, তারা পথশিশু। তবে ঈদ মানে তাদের কাছে চাপা কান্নাও বটে। তাদের ঈদ কাটে কষ্ট ও হৃদয়শূন্যতার মাঝে। খুশির দিন হলেও খুশির লেশমাত্রও থাকে না তাদের। এ দেশে অসংখ্য শিশু রাস্তার বাসিন্দা। এদের অনেকের মা-বাবা নেই। আত্মীয়-স্বজন নেই। নেই কোনো ঠিকানা। শীত-গ্রীষ্ম আর রোদ-বৃষ্টিতে এদের অবস্থান ফুটপাত, ওভারব্রিজ আর যানবাহনের স্টেশনে। ঈদ উপলক্ষে সব পথশিশু পায় না নতুন জামা। খেতে পারে না ভালো ভালো খাবার। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করার কেউ থাকে না তাদের পাশে। নতুন কাপড় পরে ঈদগাহে যাবার সুযোগ হয় না অনেকের। এ এক এমনই কষ্ট যা কাউকে বলাও যায় না, আবার সইতেও পারা যায় না। সারা বছর যেখানে দু’বেলা খাবার পেতে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়, সেখানে নতুন জামা তো স্বপ্নের ব্যাপার। ঈদ তো অন্য সাতটা দিনের মতোই চলে যায়। এমনই ঈদ কাটাতে হয় পথে পথে বেড়ে ওঠা পথশিশুদের। সাধারণ আর দশটা ছেলেমেয়েদের মতো কাটে না তাদের ঈদ।
পথশিশুদের জীবনযাপন অত্যন্ত দুর্বিষহ। অধিকাংশ সময়ই রাস্তা, পার্ক, ট্রেন ও বাস স্টেশন, লঞ্চঘাট, সরকারি ভবনের নিচে ঘুমায় এবং প্রতিনিয়তই নাইট গার্ড কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দ্বারা তাদের হতে হয় নির্যাতনের শিকার। বিভিন্ন হোটেলের পচা-বাসি খাবার, এমনকি ডাস্টবিনে ফেলা দুর্গন্ধযুক্ত খাবারও খেয়ে থাকে। রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক লাখ পথশিশু রয়েছে যাদের ৮০ ভাগেরই জন্ম ফুটপাথে। বলা চলে পথে জন্ম, পথেই তাদের বসবাস। স্বজনহারা অনেক শিশুও শহরে এসে এই তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। অবহেলা-অযতেœ বেড়ে ওঠা এই শিশুদের টোকাই বা পথশিশু বলা হয়। ঈদ উচ্ছাসে যখন কেনাকাটা আর নানা আয়োজন ভাবনায় মশগুল অনেকে তখন রাজধানীর তেজগাঁও, মহাখালী, মিরপুর, আগারগাঁও, কমলাপুরসহ বিভিন্ন এলাকার পথশিশুরা চেয়ে থাকেন বিত্তবানদের সাহায্যের আশায়। ঈদ নিয়ে তাদের বাড়তি কোনো ভাবনাও নেই। বছরের প্রতিটি দিন যেমন অনাহারে শুরু হয়, ঈদের দিনকেও এর আলাদা করে ভাবতে পারে না তারা। তবে ঈদে কেউ যদি কোনো পুরনো কাপড় দেন, তাহলে কিছুটা হলেও লজ্জা নিবারণের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে ভেবে দুয়ারে দুয়ারে ঘোরে তারা। কারও ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে দু-একটা কাপড় মেলে, অন্যথায় ছেঁড়া কাপড়েই কাটে ঈদ।
আট কি নয় বছর বয়সের শিশু কবির। মাথায় উষ্কখুষ্ক চুল। বোঝা যায় দীর্ঘদিন অপরিছন্নতাজনিত জট। থাকে কমলাপুরের রেল স্টেশনে অথবা রেল স্টেশন এলাকার আশপাশের পথের ফুটপাতে। ঈদে কোথায় থাকবে, কি করবেÑপ্রশ্ন করতেই নানা কথা জানায় সে। আমাদের কি আর ঈদ আছে আমরাতো থাকি পথে পথে। কেউ আমাদের নিয়ে ভাবেনা। আমরা খেয়ে না খেয়ে কাটিয়ে দেই ঈদের সময়টুকু। মা-বাবা থাকলে হয়তো ভালো ভাবে ঈদের সময়টুকু কাটাতে পারতাম। তা কি আর আমাদের ভাগ্যে আছে। হতাশা আর আক্ষেপে কথাগুলো বলে সে। সাইফুল (১০) অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটে যার। মা নেই। বাবা রিকসা চালক। সরাদিন থাকেন বাইরে। ঈদে নতুন কাপড় কিনে দিবেন বলেছেন বাবা। এখনও সে বলতে পারছে না কবে পাবে নতুন জামা। তার সাথে আছে একই বয়সের আরো কয়েকজন সাবিনা, জোসনা, লাবন্য, শরিফ, রাসেলসহ কয়েকজন। তাদেরও একই অবস্থা। ঈদ কেমন কাটবে এখনো বলতে পারছে না কেউ।
দশ বছর ধরে পথশিশুদের নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করছেন ব্রাদার লুসিও বেনিনাথি। পথশিশুদের কাছে তিনি লুসিও ভাই নামেই পরিচিত। পথশিশুদের জীবন সুস্থ-সুন্দর করতে তিনি গড়ে তুলেছেন পথশিশু সেবা সংগঠন। তিনি বলেন, ভালোবাসা ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না। ভালোবাসা না পাওয়ায় অনেক শিশু রাস্তায় থাকে। অনেকের পারিবারিক ঝামেলার কারণেও পথশিশু হয়ে যায়। তিনি আরো বলেন, অনেকের মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া তাদের পথশিশু করে দেয়। পরিবারের মা অথবা বাবার ২য বিয়ের ফলে শিশুকে পরিবার ভালোভাবে নিতে পারে না তাই তারা পথশিশু হয়ে যায়। আমরা চাই তারা যেন রাস্তায় না থাকে। তাদের একটি ভালো ঠিকানা দরকার। যেন তারা ভালো থাকতে পারে। ঈদের দিনে শিশুদের নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা আছে। তাদের নিয়ে শিশু মেলাতে যাব। শহরের বিভিন্ন জায়গায় তাদের নিয়ে কাজ করবো। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কাছেও তাদের নিয়ে যাবার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন