শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

করোনাভাইরাস নিয়ে পরিকল্পিত গুজব!

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০০ এএম

চীনে করোনাভাইরাস নিয়ে তোলপাড় চলছে। চলছে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। পশ্চিমা মিডিয়াগুলোতে এ রোগ নিয়ে ফুলিয়ে ফাপিয়ে খবর প্রচার করা হচ্ছে। চীনের বিরুদ্ধে আতঙ্ক ছড়িয়ে মানুষের মধ্যে ভীতি সঞ্চর করা হচ্ছে। অথচ বিশেষজ্ঞরা করোনাভাইরাস নিয়ে মানুষকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। চীন থেকে বাংলাদেশে যারা এসেছেন তাদের কারো শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন ফেরত কারো শরীরে ভাইরাস না পাওয়ায় আতঙ্কের কিছু নেই। সম্প্রতি সময়ে ডেঙ্গু রোগের পাদুর্ভাব মোকাবেলায় সরকার সেভাবে সাফল্য দেখিয়েছে; করোনাভাইরাস আসার আগেই সে ভাবেই মোকাবিলার সক্ষমতা রয়েছে। অতএব গুজবে কান দেবেন না।

জানতে চাইলে রাগতত্ত¡, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (আইইডিসিআর) পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। অথচ আতঙ্কের কিছু নেই। চীন ফেরত কারোই এ রোগ পাওয়া যায়নি। মানুষের উচিত আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়া। বাংলাদেশ-চায়না বিজনেস অ্যাসোসিয়েশেনের সভাপতি যাদব দেবনাথ বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো ‘মিথ্যা খবর’ প্রচার করে গুজব ছড়াচ্ছে। তারা চীনকে ব্যবসায়িক ভাবে মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েই এই অসৎ পথ ধরেছে। বাস্তবতা হলো চীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে।
‘তোমার ছেলের করোনাভাইরাস হয়েছে। পুলিশ তাকে খুঁজছে। হাসপাতালের লোকজন তাকে খুঁজছে, গত সোমবার এলাকাবাসীর এমন নানা কথাবার্তায় ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন রেণুকা বালা। ওই রাতেই হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান তিনি।’ ঘটনাটি ঘটেছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাতাখালি গ্রামে। অবশ্য ছেলের বিপদ নিয়ে উদ্বেগই রেনুকা বালার হার্ট অ্যাটাকের কারণ কি না, সেটা স্পষ্ট হওয়া যায়নি চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে। তবে এই ঘটনাটি ওই এলাকায় দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বা গুজব ছড়িয়ে এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতির তৈরি করা হয়েছে।

যাকে নিয়ে আলোচনা, সেই রেণুকা রপ্তানের ছেলে রতন রপ্তান জানান, গত সোমবার ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরেন। সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে পৌঁছালে সবার মতো তারও স্ক্রিনিং করা হয়। এ সময় তার শরীরে জ্বর সেইসঙ্গে সর্দি-কাশি ধরা পড়ে। পরে ইমিগ্রেশনের চেকআপ ইউনিটের কর্মকর্তারা তাকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন পরবর্তী স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য। চিকিৎসকরা তার রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। সেই পরীক্ষার ফল হাতে পেয়ে রতন রপ্তান জানান, তার শরীরে করোনাভাইরাসের কোন উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। এদিকে হবিগঞ্জে কিছুদিন আগে চীন ফেরত এক শিক্ষার্থীকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। দু’দফায় তিনি হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেলেও পুলিশের মাধ্যমে তাকে খুঁজে আনা হয়। অথচ তারমধ্যে করোনাভাইরাসের কোন লক্ষণ নেই। এছাড়া গত রোববার রংপুরে চীনফেরত এক শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে ভর্তি করার খবরে এলাকায় চাঞ্চল্য শুরু হয়। যদিও শিক্ষার্থীটির শরীরে করোনাভাইরাসের কোন উপসর্গ ছিল না, তারপরও তাকে করোনা ইউনিটে নিয়ে আলাদা করে রাখার পর এই পরিস্থিতি সৃস্টি হয় বলে জানা গেছে।

শুধু বাংলাদেশের রতন রপ্তানকে নিয়ে আতঙ্ক বা গুজব নয়; বিশ্বব্যাপী গত কিছুদিন থেকে আতঙ্কের নাম নোভেল করোনাভাইরাস। চীনের কয়েকটি প্রদেশ ব্যতীত বিস্তার তেমন না হলেও বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন করোনাভাইরাস। আর এ আতঙ্ক ভাইরাসের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস খুব অল্প সময়ে চীনসহ প্রায় ২৫টি দেশে ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ না হওয়া স্বত্তেও উদ্বেগের পারদ নামছে না। মানুষের এই উদ্বেগে অনেকটা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ফেইক নিউজ। করোনাভাইরাস বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং ইতোমধ্যে কয়েকজন এতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে- এ ধরণের ভুয়া তথ্য প্রচারের জন্য সম্প্রতি পাঁচজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ।

পুলিশ বলছে, ওই পাঁচজন নিজেদের ভুল স্বীকার করে সব ভুয়া খবর ইতিমধ্যে তুলে নিয়েছে। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরবর্তীতে আর কোন ভুয়া তথ্য ছড়াবে না বলেও লিখিতভাবে পুলিশকে জানিয়েছেন তারা।

রাজধানীতে ব্যবসায়ীদের এক অনুষ্ঠানে ইতোমধ্যে করোনাভাইরাস নিয়ে পশ্চিমারা অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে। বাংলাদেশ-চায়না বিজনেস অ্যাসোসিয়েশেনের সভাপতি যাদব দেবনাথ বলেছেন, করোনাভাইরাস নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমে ‘মিথ্যা খবর’ প্রকাশ করে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। ভাইরাস মোকাবেলায় তিনি চীনের কাজের প্রশংসা করে বলেছেন, এ ধরনের ভাইরাসকে একটি নির্ধারিত স্থানে সীমাবদ্ধ করে রাখতে ইতোমধ্যেই চীন তার সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। অচিরেই তা পুরোপুরি নির্মূল করা যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং মানুষের প্রাণহানির খবরের পর ছোঁয়াচে এই রোগটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে একটি চক্র। তারা বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষ শনাক্ত হয়েছে, এমন দাবি তুলেও সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়াচ্ছে। এই ভাইরাস ছড়ানোর পেছনে দায়ী করা হচ্ছে অদ্ভুত সব কারণকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরণের ফেইক নিউজ ভাইরাসের মতোই ক্ষতিকর হতে পারে।

যদিও রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কারও মধ্যে করোনাভাইরাসের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
গুজবে কান না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আইইডিসিআরের পরিচালক প্রফেসর ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। এক্ষেত্রে উদ্বিগ্ন না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, যেগুলো জনমনে আতঙ্ক তৈরি করছে। যেমন- ফেসবুকে আমি একটি পোস্ট দেখি- ভারতে দুই হাজারের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত। অথচ ভারতে ২০০০ জন চীন থেকে ফিরেছেন, তাদের কেবল পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তারা কেউ আক্রান্ত নন। এছাড়া বাংলাদেশের অমুক জেলায় করোনা রোগী সনাক্ত হয়েছে, এমন খবরও দেখেছি, যেগুলোর কোন ভিত্তি নেই।

ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা মনে করছেন মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এবং সেটাকে তিনি অধিক মাত্রায় প্রচার প্রচারণা সচেতন করার চেষ্টার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বলে মনে করেন। তিনি বলেন, আমার মনে হয় আমাদের প্রচার-প্রচারণা মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি, মানুষের মনের মধ্যে কিছুটা আতঙ্কও সৃষ্টি করে ফেলেছে। আবার মানুষ সঠিকভাবে সচেতন হচ্ছে কি না কিংবা আতঙ্কিত হয়ে ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
তিনি বলেন, রংপুর মেডিকেল কলেজের ঘটনায় রোববার বহু মানুষ আতঙ্কিত হয়ে হাসপাতালে ছুটে আসছিলেন। হাসপাতালটির নবনির্মিত করোনা ইউনিটের ঠিক সামনেই দিনভর ভিড় করেন। অথচ আতঙ্কিত হবার সত্যিই যদি কোন কারণ থাকতো তাহলে এই মানুষগুলোর হাসপাতালের ত্রিসীমানায় ভেড়ার কথা নয়।
এদিকে গত পহেলা ফেব্রুয়ারি চীনের উহান শহর থেকে ৩১২ জন বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়। তাদের কোয়ারান্টিনে ১৪ দিন রেখে নিজ নিজ বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাদের কারও মধ্যেই ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়নি। এছাড়া চীন থেকে স¤প্রতি যারা বাংলাদেশে ফিরেছেন বিশেষ করে বাংলাদেশে যেসব চীনা নাগরিক আছেন তাদের কারও মধ্যে এই রোগের লক্ষণ দেখা যায়নি।

তারপরও করোনাভাইরাস নিয়ে এই ভুয়া খবরগুলোর কারণে এই মানুষগুলোকে পারিবারিকভাবে এবং সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হতে হচ্ছে বলে আক্ষেপ করেন প্রফেসর ডা. ফ্লোরা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন