বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সারা বাংলার খবর

শত বছরের ইতিহাস মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাণীনগরের কাশিমপুর রাজবাড়ি

নওগাঁ জেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ২:০১ পিএম

শত বছরের ইতিহাস মাথায় নিয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার একমাত্র ঐতিহাসিক কাশিমপুর রাজবাড়ি। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৫কিলোমিটার পশ্চিমে ছোট যমুনা নদীর তীরে ২নং কাশিমপুর ইউনিয়নের কাশিমপুর গ্রামে অবস্থিত এই রাজবাড়িটি। রাজবাড়িটি প্রধানত পাগলা রাজার বাড়ি বলে পরিচিত। এই রাজবাড়িকে ঘিরে রয়েছে অনেক ইতিহাস। রাজবাড়ির প্রধান অংশের শুধুমাত্র দুর্গা মন্দিরের কিছু অংশ এখন শুধুই কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দিন দিন এই শেষ অংশটুকুও এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। মৃত প্রায় রাজবাড়ির নির্মাণ শৈলী, নকশা ও ডিজাইন এখনো দর্শনার্থীদের মন কেড়ে নেয়।

কাশিমপুরের এই পাগলা রাজা ছিলেন নাটোরের রাজার বংশধর। এই অঞ্চলের রাজত্ব দেখভাল করার জন্যই মূলত এখানে তৈরি করা হয়েছিলো রাজবাড়ি আর সূত্রপাত করা হয়েছিলো রাজার শাসন। তবে এই অঞ্চলে কবে রাজার শাসন প্রবর্তন শুরু হয়েছিলো তা জানা যায়নি। শ্রী অন্নদা প্রসন্ন লাহিড়ী বাহাদুর ছিলেন এই রাজত্বের শেষ রাজা। তার চার ছেলে ও এক মেয়ে ছিলেন। ১৯৪৭সালে দেশ ভাগের পর রাজবংশের সবাই এই রাজত্ব ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চলে যান। শুধুমাত্র ছোট রাজা শ্রী শক্তি প্রসন্ন লাহিড়ী বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই এই রাজবাড়িতে বসবাস করেছিলেন। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি ও তার পরিবার এই রাজবাড়ির স্টেটের অঢেল সম্পদ রেখে ভারতে চলে যান। রাজবাড়ির এলাকা ছিলো ২একর ১৯ শতক জমি নিয়ে। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এই রাজবাড়িটির নিদর্শন সমূহ দীর্ঘদিন যাবত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে সকল কারুকার্য আজ প্রায় ধ্বংসের পথে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় যে রাজবাড়ির মূল ভবনের মাঝখানে শুধুমাত্র দুর্গা মন্দিরের সামনের চারটি গম্বুজসহ কিছু অংশ ক্ষতবিক্ষত প্রাচীর ও দেয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তর দিক দিয়ে রাজবাড়িতে প্রবেশ করার পথেই রয়েছে শিব, রাধাকৃষ্ণ ও গোপাল মন্দির। চুন, সুড়কি ও পোড়া মাটির ইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছিলো এই মন্দিরগুলো। মন্দিরগুলোর মধ্যে রাধাকৃষ্ণ মন্দিরটি সুউচ্চ হলেও অপরদুটি মন্দিরের নির্মাণ কৌশল একই নকশার। বর্তমানে এই তিনটি মন্দির স্থানীয় সনাতন ধর্মের লোকেরা দখল করে দীর্ঘদিন যাবত বসবাস করছেন ও পূজাঅর্চনা দিয়ে আসছেন। দুর্গা মন্দিরের পাশে ছিল রাজার বৈঠকখানা, পুকুরপাড় ও নদীর ধারে একটি কাঁচের ঘরের তৈরি বালিকা বিদ্যালয়। এই সবের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

বর্তমানে রাজার জায়গার কিছু অংশ এখন কাশিমপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়াও রাজবাড়ির শত শত বিঘার সকল জায়গার সবটুকুই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দখল করে তৈরি করেছেন নামে বেনামে অসংখ্য ধানের চাতাল। আবার খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে বিভিন্ন অংকের অর্থের বিনিময়ে লিজ দিয়েছেন। স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা আর দখলদারদের অবৈধ শাসনের ভারে রাজবাড়ির যেটুকু স্মৃতিচিহ্ন অবশিষ্ট রয়েছে তাও আবার দিনে দিনে সংস্কার ও সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দ্বায়িত্বশীল মহল রাজবাড়ি ও রাজার সম্পদগুলোর উপর সঠিক নজরদারী না করার কারনে কোটি কোটি টাকার সম্পদ বেহাত হওয়ার মাধ্যমে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব থেকে। এখনো আশেপাশের অনেক দর্শনার্থীরা রাজবাড়িটির শেষ স্মৃতিচিহ্নগুলো দেখতে আসেন।

রাজবাড়ি দেখতে আসা উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের দর্শনার্থী কোমল হাসান বলেন আমাদের এই উপজেলায় একটি আধুনিক মানসম্মত বিনোদন কেন্দ্র নেই। একটি বিনোদন কেন্দ্র থাকলে মাঝে মধ্যে আমরা স্বপরিবারে ও ছোট বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে যেতে পারতাম। তাই ঐতিহ্যবাহী এই রাজবাড়ির যে স্থাপনাগুলো অবশিষ্ট রয়েছে সেগুলো সংঙ্কার করে একটি আকর্ষনীয় বিনোদন কেন্দ্র তৈরি করা যেতে পারে। আর এই কাজের জন্য শুধুমাত্র সরকারের সুদৃষ্টি যথেষ্ট। এতে করে এই উপজেলা ও আশেপাশের মানুষরা পেতে পারেন একটি বিনোদন কেন্দ্র আর সরকারও পেতে পারেন রাজস্ব। কারণ বিনোদন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারেন না। তাই এই রাজবাড়িটিকে ঘিরে এখানে একটি বিনোদন ও আকর্ষনী পর্যটন কেন্দ্র তৈরি করার জন্য সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি।

রাজবাড়ির মন্দিরে বসবাসরত মালা রানী বলেন আমরা ছিন্নমূল মানুষ। তাই দীর্ঘদিন ধরে পরিবার নিয়ে এই মন্দিরে এসে বসবাস করছি। আমরা এখানে বসবাস করছি বলেই আজোও রাজবাড়ির কিছু ঐতিহ্যবাহি এই নিদর্শনগুলো বেঁচে আছে। তা না হলে এগুলোও বেদখল করে নষ্ট করে ফেলা হতো। আমরা এই মন্দিরগুলোতে নিয়মিত পূজা-অর্চনা দিয়ে আসছি। তবে এগুলো সংস্কার ও সংরক্ষন করা খুবই জরুরী। তাছাড়া আর কিছু দিন পর এইগুলোও অবশিষ্ট থাকবে না। এই রাজবাড়ির ইতিহাস চিরদিনের জন্য মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। শত বছরের ইতিহাস ও রাজবাড়ির ঐতিহ্য যুগের পর যুগ ধরে রাখার জন্য সরকারের জরুরী পদক্ষেপ প্রয়োজন।

২নং কাশিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: মকলেছুর রহমান বাবু বলেন, দেশ স্বাধীনের পর রাজার বংশধররা কয়েক দফায় এই রাজত্ব ছেড়ে ভারতে চলে যান। তারা চলে যাওয়ায় স্থানীয় কিছু ব্যক্তিরা রাজার এই বিশাল সম্পত্তি পেশীবলের জোরে দখলে করে নেয়। এক সময় বিভিন্ন কায়দায় উপজেলা ভূমি অফিস থেকে লীজ নেওয়ার কথা আমি শুনেছি। এমনকি বড় বড় দালানকোটা ঘেড়া প্রাচীর ও রাজার প্রাসাদের ইট খুলে প্রকাশ্যে দিবালোকে ও রাতের আঁধারে স্থানীয়রা লুটপাট করে বিক্রয় করেছে। দিন যতই যাচ্ছে এই রাজবাড়ির স্মৃতিচিহ্নগুলো ততই হারিয়ে যাচ্ছে। শতবছরের এই রাজবাড়ির ইতিহাসকে সংরক্ষন করার জন্য সরকারের দায়িত্বশীল মহলের কার্যকরি পদক্ষেপ খুবই জরুরী। তা না হলে আর কিছু দিনের মধ্যেই রাজার শাসনের ইতিহাস ও রাজবাড়ির স্মৃতিচিহ্নটুকুও সময়ের সাথে বিলীন হয়ে যাবে। তাই এই রাজবাড়ি ও রাজবাড়ির অবশিষ্ট সৌন্দর্য্য এবং এখানকার ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারের সঙ্গে আমাদের সকলের উচিত এক সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করা।
নির্বাহী কর্মকর্তা আল মামুন বলেন সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে এই রাজবাড়ির অবশিষ্ট অংশগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণ করে একটি বিনোদন কেন্দ্র তৈরির বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন