মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে শান্তিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের সদস্যদের বিরুদ্ধে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো ২০১৪ সালের বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত হলেও কয়েক সপ্তাহ আগে তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়। গত শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুদের অভিযোগের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক তদন্তে এই মারাত্মক অপকর্মের তথ্য উঠে এসেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়নের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অভিযোগ করেছেন এই বলে যে, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা না নেয়ার ব্যর্থতার জন্য এমন ঘটনা ঘটেছে। স্মরণ করা যেতে পারে, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফ্রিকার এই দেশটিতে ২০১৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৭০০ সেনা মোতায়েন করা হয়। ওই বছরই সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হলে শান্তিরক্ষার দায়িত্ব ইইউ’র হাত থেকে জাতিসংঘের হাতে ন্যস্ত হয়। দেশটিতে এখন অর্ধশতাধিক দেশের ১৩ হাজারেরও বেশি সেনা ও পুলিশ সদস্য শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশসহ সাতটি দেশের সদস্যদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। জাতিসংঘের অন্যতম সহকারী মহাসচিব এন্থনি প্যানবারি শুক্রবারের সংবাদ সম্মেলনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছেন, জাতিসংঘের তরফে শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত সদস্যরা এমন ভয়াবহ অপরাধ করতে পারেন, তা ভাবাই যায় না। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের সব রকম সাহায্য করা হবে। এই সঙ্গে দায়বদ্ধতা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যতে যাতে অনুরূপ ঘটনা না ঘটে সে জন্য জাতিসংঘ সচেষ্ট থাকবে।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠার এ ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এর নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। যারা বিপন্ন মানুষের নিরাপত্তা প্রদান ও শান্তি-স্থিতি প্রতিষ্ঠার মহোত্তম দায়িত্বে নিয়োজিত, তারা যদি এ ধরনের ভয়ঙ্কর অপরাধ করেন তাহলে মানুষ কোথায় নিরাপত্তা ও আশ্রয় পাবে? মানবতার বিরুদ্ধে এর চেয়ে চরম অপরাধ আর কিছু হতে পারে না। আমরা অত্যন্ত মর্মাহত ও দুঃখিত যে, অভিযুক্তদের মধ্যে বাংলাদেশীও রয়েছেন। বলা যায়, তারা যে বাহিনীর সদস্য সেই বাহিনীর সুনাম, মর্যাদা, ভাবমূর্তি তো বিনষ্ট করেছেনই সেই সঙ্গে দেশের সম্মান-সুনামও ভূলুণ্ঠিত করেছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও দেশের ওপর অমোচনীয় কলঙ্কের কালিমা লিপ্ত করেছেন। আইএসপিআর-এর তরফে বলা হয়েছে, বিষয়টি তদন্তাধীন আছে। প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বলা হয়েছে, যৌন নিপীড়নের ঘটনা সত্য হলে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ১৯৮৮ সাল থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করে আসছে। এর সদস্যরা এ পর্যন্ত ৪০টি দেশে ৫৪টি মিশনে অংশ নিয়ে বিশ্বব্যাপী সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ২০ হাজার সদস্য শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করেছেন। সঙ্ঘাত-বিক্ষুব্ধ ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার কাজে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি তারা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে সামাজিক ও অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা-চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অসাধারণ ভূমিকা ও অবদান রেখেছেন। সর্বত্রই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা অনুকরণীয় নজির স্থাপন করেছেন এবং প্রশংসিত হয়েছেন। জাতিসংঘ জাতিরক্ষী বাহিনীর অংশীদার বিভিন্ন দেশের বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন, যৌন হয়রানি ও নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা এ ধরনের অপরাধের অভিযোগ থেকে ছিলেন সম্পূর্ণ মুক্ত। প্রশ্ন হলো, এতদিন পর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠল কেন? উন্নত চরিত্র, সৎস্বভাব ও সদাচারের জন্য খ্যাত এই বাহিনীর কিছু সদস্যের চরিত্র-স্বভাব-আচারে এই বিচ্যুতি ও স্খলন দেখা গেল কেন? যতদূর জানা যায়, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে যাদের পাঠানো হয়, তাদের স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ, সক্ষমতা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসহ অনেক কিছুই বিবেচনা করা হয়। এই বিবেচনার ক্ষেত্রে কি কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে? দেশরক্ষার মহান দায়িত্ব পালন ও মানব সেবার পাশাপাশি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যের প্রয়োজনে আরো বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। সব ক্ষেত্রেই সৎচরিত্র ও কর্তব্যনিষ্ঠা তাদের সম্পদ। কোথাও এর ব্যতিক্রম ঘটলে বিচলিত না হয়ে পারা যায় না। সঙ্গতকারণেই আমরা আশা করতে চাই, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশী সদস্যের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের যে অভিযোগ উঠেছে তা কতটা সত্য, সেনাবাহিনী উপযুক্ত তদন্তের মাধ্যমে সে বিষয়ে নিশ্চিত হবে। যারা দোষী সাব্যস্ত হবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করবে। এইসঙ্গে সেনাসদস্য হিসেবে তাদের চরিত্রের এই অধঃপতন কেন ঘটল তা খতিয়ে দেখবে এবং প্রতিবিধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। এটা একটি গুরুতর বিষয় এবং সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষকে তা বিবেচনায় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন