‘মানব পাচার’ একটি সামাজিক ব্যাধি। কোনো ব্যক্তিকে তার দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে বিক্রি বা পাচারের উদ্দেশ্যে লুকিয়ে রাখা, আশ্রয় দেওয়া, অন্যকোনভাবে সহায়তা করা হলে মানবপাচার হিসেবে গণ্য হবে। বাংলাদেশের মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ অনুযায়ী, ‘মানবপাচার’ অর্থ কোনো ব্যক্তিকে ভয় দেখিয়ে, বল প্রয়োগ বা প্রতারণার মাধ্যমে তাঁর আর্থ-সামাজিক, পরিবেশগত বা অন্য কোনো অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এবং টাকা-পয়সার বিনিময়ে বা অন্যকোন সুবিধা লাভের জন্য তাঁর উপর নিয়ন্ত্রণ আছে এমন কারো সম্মতি নিয়ে এবং বাংলাদেশের ভিতরে বা বাইরে যৌন শোষণ, শ্রম শোষণ অথবা অন্যকোন শোষণ বা নিপীড়নের উদ্দেশ্যে ক্রয় বা বিক্রয়, সংগ্রহ বা গ্রহণ, নির্বাসন বা স্থানান্তর, চালান বা আটক করা বা লুকিয়ে রাখা বা আশ্রয় দেয়া। উল্লেখ্য, পাচারের শিকার ব্যক্তির বয়স ১৮ বছরের কম হলে বলপ্রয়োগ, প্রতারণা বা প্রলোভন দেয়া হয়েছে কি না তা বিবেচনা করার দরকার নেই বরং শোষণ বা নিপীড়ন হলেই তা মানবপাচার প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। অপরাধের মাত্রাভেদে আইনের মধ্যে মানবপাচারের বিভিন্ন রকম শাস্তির বিধান রঢেছে। এ আইনের ৬ ধারা অনুসারে মানব পাচার নিষিদ্ধ করে এর জন্য অনধিক যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ধারা ৭ অনুসারে সংঘবদ্ধ মানবপাচার অপরাধের দন্ড মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা কমপক্ষে সাত বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদন্ড।
এ ছাড়া এ আইনের ধারা ৮ অনুসারে অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা, ষড়যন্ত্র বা চেষ্টা চালানোর দন্ড হিসেবে অনধিক সাত বছর এবং কমপক্ষে তিন বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা অর্থদন্ড রাখা হয়েছে। ধারা ৯ অনুসারে জবরদস্তি বা দাসত্বমূলক শ্রম বা সেবা প্রদান করিতে বাধ্য করার দন্ড অনধিক ১২ বছর এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড। উক্ত আইনের ধারা ১০ অনুসারে মানবপাচার অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্যে অপহরণ, চুরি এবং আটক করার দন্ড এবং মানব পাচারের অপরাধ সংঘটনের অভিপ্রায়ে বা যৌনশোষণ ও নিপীড়নের শাস্তি অনধিক ১০ বছর এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত রাখা হয়েছে। নবজাতক শিশু অপহরণ বা চুরির দন্ড অনধিক যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড রাখা হয়েছে। এ আইনের পতিতাবৃত্তি বা অন্য কোনো ধরনের যৌনশোষণ বা নিপীড়নের জন্য আমদানি বা স্থানান্তরের দন্ড অনধিক সাত বছর এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড রাখা হয়েছে। এ আইনের অধীন অপরাধগুলো আমলযোগ্য, আপোষ অযোগ্য এবং অ-জামিনযোগ্য।
হতাশার বিষয় হলো, নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মানবপাচার অব্যাহত রয়েছে। প্রশ্ন হলো, এ ধরনের সুনির্দিষ্ট আইন থাকার পরও কেন তা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না? অধিক জনসংখ্যা, অসচেতনতা, দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, দ্রুত নগরায়ন, মাদক ও যৌন ব্যবসা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি বাংলাদেশকে এশিয়ার অন্যতম শিশু ও নারী পাচারের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করেছে। আবার সুখী ও উন্নত জীবনের প্রলোভনে পড়ে আশ্রয়হীন; অসহায় ও হতাশাগ্রস্ত শহরমুখী নারী ও শিশুরাও পাচারের কবলে পড়ে। একশ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী চক্র নারী ও শিশুদের চাকরি, বিবাহ, ভালোবাসা বা অন্য কিছুর প্রলোভন দেখিয়ে তাদের বিদেশে পাচার করে চলেছে। বছরের পর বছর এসব পাচারকৃত নারী ও শিশু শারীরিক ও যৌন নির্যাতন সহ্য করছে এবং ব্যবহৃত হচ্ছে কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর ট্রাফিকিং ইন পারসন্স (টিআইপি) রিপোর্ট ২০১৯ অনুযায়ী, প্রতিবছর অনেকেই অনিয়মিত চ্যানেলগুলির মাধ্যমে পাচার হন এবং পাচারকারীদের হাতে শোষণ এবং নির্যাতনের শিকার হয় এই মানুষগুলো। যারা অবৈধভাবে বা অনিয়মিতভাবে বিদেশে যায় বা যেতে বাধ্য হয় তারা সীমাবদ্ধ চলাচল, ঋণচুক্তি, জোরপূর্বক শ্রম, যৌন নিপীড়ন, জোরপূর্বক বিবাহ এবং দাসত্বের মতো সমস্যায় পরেন। মানবপাচার প্রতিরোধে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। নিজেকে এবং অন্যদের পাচারের হাত থেকে রক্ষা করুন, নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে সহায়তা করুন। আপনার অধিকারগুলো জানুন এবং সব সময় সেগুলো আদায় করার চেষ্টা করুন। পছন্দের দেশ বা চাকরিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে ঝুঁকিগুলো যাচাই করুন। আপনার ভবিষ্যৎ আপনি নিজেই স্থির করুন এবং জেনে ও বুঝে আপনার সিদ্ধান্ত নিন। নিবন্ধিত শ্রম অভিবাসী উপায়গুলো জেনে নিন। যেসব সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থা পাচার প্রতিরোধে কাজ করে তাদের সঠিক তথ্য দেয়া ও সহায়তা করা কর্তব্য।
দেশের বাইরে যাওয়ার পূর্বে এটা অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে যেসব ব্যক্তি যোগাযোগ করছে এবং দিক নির্দেশনা দিচ্ছে তারা নিয়োগদাতার বৈধ এবং আইনগত স্বীকৃত প্রতিনিধি কিনা। এ অন্যদিকে এ অবক্ষয় প্রতিরোধে বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্রের পরিচয় জানা এবং মেয়ের অভিভাবকের ছেলের পারিবারিক অবস্থান সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া প্রয়োজন। পাচারের পরিণতি সম্পর্কে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং পরিবারের সবাইকে সচেতন করা কর্তব্য। কাজের লোক নিয়োগ করার ক্ষেত্রে ছবি তুলে রাখা এবং প্রাক-পরিচয় যাচাই করে নেয়া আবশ্যক। বাড়ির শিশুকে নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বর মুখস্থ করানো, অপরিচিত লোকের দেয়া কোনো খাবার বা জিনিস যাতে গ্রহণ না করে সে বিষয়ে পরিবার থেকেই শিশুকে সচেতন করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে এ বিষয়ে তথ্যকেন্দ্র পরিচালনা করা প্রয়োজন, যাতে পাচার, শোষণ, অবহেলা, নির্যাতন বা অন্য যে কোনো নেতিবাচক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব হয়। পাশাপাশি মানবপাচার রোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা এবং বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। মানবপাচারের বিষয়টি এখন উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। এটি ঠেকাতে আমাদের দারিদ্র্য কমাতে হবে। বৃদ্ধি করতে হবে তরুণদের দক্ষতা। একইসাথে যারা বিদেশে যেতে আগ্রহী তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি পাচার রোধে আইনগুলো কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার, যাতে পাচারকারীরা দ্বিতীয়বার এই অপরাধ করতে ভয় পায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। নারী ও শিশুদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য মানব পাচার বন্ধ করতে হবে। আর এ জন্য সমাজের সচেতন জনগোষ্ঠিকে পাচারের বিরুদ্ধে দুর্লঙ্ঘ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন