আমির সোহেল
বর্তমানে দেশের মানুষ অনেক সৌখিন। তারা আর আগের মতো পরিশ্রম করতে চায় না। হাতের নাগালেই চাহিবামাত্র সবকিছুই পেতে চায়। ধরুন কেনাকাটা করা। এই জিনিসটা অনেক ঝক্কি-ঝামেলার কাজ। উৎসব উদযাপনের সময় ভিড় আর গরম সহ্য করে কেনাকাটা করা মহা বিরক্তিকর একটা ব্যাপার। যাতে খুব নাজেহাল হতে হয় তখন। দিন দিন মানুষ যত বেশি আরামপ্রিয় হয়ে উঠছে ততই তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় সব হাতের নাগালেই চলে আসার ব্যবস্থা হচ্ছে। দেশও ডিজিটাল হচ্ছে। সব কিছুতেই প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগছে। আর এই মার্কেটে মার্কেটে ঘুরে মহা বিরক্তকর কেনাকাটা থেকে মুক্তি মিলছে ই-কমার্সের কারণে। ঘরে বসেই অনলাইনে পছন্দ করে অনলাইন থেকেই কেনাকাটা দিন দিন খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ই-কমার্সের মাধ্যমে আপনি সব ধরনের পণ্য কিনলে আপনার নির্দিষ্ট ঠিকানায় তারা পৌঁছিয়ে দিচ্ছে। হাতে পাওয়ার পর মূল্য পরিশোধ করতে হয়। ক্রমেই সব ধরনের মানুষের কাছে ই-কমার্স বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে। ক্রেতা বাজারে বাজারে ঘোরার ঝামেলা থেকে বাঁচছে আর সেই সাথে অর্থের সাশ্রয়ও হচ্ছে। ই-কমার্সে তাই ক্যারিয়ার গড়ে তুলছে অনেক তরুণ। হয়ে উঠছে সফল উদ্যোক্তা।
ই-কমার্স বলতে কি বোঝায়?
ইলেকট্রনিক কমার্স বা ই-কমার্স বা ই-বাণিজ্য একটি বাণিজ্য ক্ষেত্র যেখানে কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেম (ইন্টারনেট বা অন্য কোনো কম্পিউটার নেটওয়ার্ক)-এর মাধ্যমে পণ্য বা সেবা ক্রয় বা বিক্রয় হয়ে থাকে। আধুনিক ইলেকট্রনিক কমার্স সাধারণত ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের মাধ্যমে বাণিজ্য কাজ পরিচালনা করে। এ ছাড়াও মোবাইল কমার্স, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার ও অন্য আরো কিছু মাধ্যম ব্যবহৃত হয়। উইকিপিডিয়াতে এমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে।
ই-কমার্সের রকমফের
ই-কমার্সের অনেকগুলো প্রকার রয়েছে। যেমনÑ
ব্যবসা থেকে ব্যবসা : ব্যবসা থেকে ব্যবসা ইলেকট্রনিক কমার্স সম্পাদিত হয় একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। ৮০ শতাংশের মতো ইলেকট্রনিক কমার্স ব্যবসা থেকে ব্যবসা প্রকারের অন্তর্ভুক্ত।
ব্যবসা থেকে গ্রাহক : ব্যবসা থেকে গ্রাহক ইলেকট্রনিক কমার্স সম্পাদিত হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গ্রাহকের মধ্যে। এ ধরনের দ্বিতীয় সর্বাপেক্ষা বেশি ইলেকট্রনিক বাণিজ্য সম্পাদন হয়ে থাকে।
ব্যবসা থেকে সরকার : ব্যবসা থেকে সরকার ইলেকট্রনিক কমার্স সম্পাদিত হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় খাতের মধ্যে। এটি সাধারণত ব্যবহৃত হয়ে থাকে রাষ্ট্রীয় কেনা-বেচা, লাইসেন্স সংক্রান্ত কার্যাবলি, কর প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে।
গ্রাহক থেকে গ্রাহক : গ্রাহক থেকে গ্রাহক ইলেকট্রনিক কমার্স সম্পাদিত হয় একাধিক ব্যক্তি ও গ্রাহকের মধ্যে। ইলেকট্রনিক বাজার ও অনলাইন নিলামের মাধ্যমে সাধারণত এ ধরনের বাণিজ্য সম্পাদিত হয়।
মোবাইল কমার্স : মোবাইল কমার্স ইলেকট্রনিক কমার্স সম্পাদিত হয় তারবিহীন প্রযুক্তি যেমনÑ মোবাইল হ্যান্ডসেট বা পারসোনাল ডিজিটাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (চউঅ)-এর মাধ্যমে। তারবিহীন যন্ত্রের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদানের গতি ও নিরাপত্তা বৃদ্ধির সাথে সাথে এ ধরনের বাণিজ্য জনপ্রিয়তা লাভ করছে।
গ্রাহক থেকে সরকার : কখনো সরসরি জনগণের কাছ থেকে সরকার বিভিন্ন সেবার বিনিময় ফি বা কর নিয়ে থাকে। যখন এর মধ্যে কোনো মাধ্যমে থাকে না তখন এটা গ্রাহক থেকে সরকার প্রক্রিয়া বলে বিবেচিত হয়। ডিজিটাল সরকারের আওতায় এ ধরনের সেবা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ই-কমার্সের ক্ষেত্রসমূহ
ই-কমার্সের যেসব ক্ষেত্র রয়েছে তা হলোÑ
ক. পণ্য ও সেবা কেনা/বেচা।
খ. মূল্য পরিশোধ।
গ. পণ্য নিলাম।
ঘ. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্য ও সেবার মূল্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ।
ঙ. টিকিট ক্রয়।
চ. পণ্য ও সেবা অর্ডার ও বুকিং দেয়া।
ছ. অনলাইন বিজ্ঞাপন বাণিজ্য ইত্যাদি।
ই-কমার্স করার মাধ্যম
ই-কমার্স করার জন্য যেসব বিষয় দরকার হয় তা হলো, বিক্রেতার জন্য ই-কমার্স উপযোগী ওয়েবসাইট। দ্রুত ও কার্যকরভাবে অর্ডার প্রক্রিয়া করার জন্য ইন্টারনেট ও সার্ভার।
মধ্যবর্তী মাধ্যম হলো, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার, ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে মূল্য প্রদানের ও সমধর্মী সেবা প্রদানকারী ব্যাংক প্রতিষ্ঠান। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান। পণ্য ও মুদ্রা স্থানান্তর ও পরিবহনে নিরাপত্তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান।
আর গ্রাহকের জন্য হলো, ইন্টারনেট সুবিধা। মূল্য পরিশোধের জন্য ক্রেডিট কার্ড বা সমধর্মী মাধ্যম।
সরকারিভাবে দরকার হলো, ই-কমার্সের নিরাপত্তা ও মান নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় আইন ও নীতিমালা।
ই-কমার্স বর্তমানে কেমন প্রভাব ফেলছে?
ই-কমার্স বর্তমান বাজারে কেমন প্রভাব ফেলছে তা অর্থনীতিবিদদের মতে, যেহেতু ইলেকট্রনিক কমার্স গ্রাহকদের বিভিন্ন পণ্য সহজে খুঁজে পাওয়া এবং তুলনামূলক বিশ্লেষণের একটি ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে, তাই এটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে।
সফল উদ্যোক্তার গল্প
বর্তমানে বাংলাদেশে এই ই-কমার্সের জনপ্রিয় একটি প্রতিষ্ঠান হলো বিক্রয়বাজারডটকম (ইরশৎড়ুনধুধধৎ.পড়স)। এই জনপ্রিয় সাইটটি চালাচ্ছেন তিন তরুণ সফল উদ্যোক্তা। তারা পড়াশোনার পাশাপাশি অনলাইন কেনাকাটার সাইটটি দক্ষতার সাথে পরিচালনা করছেন। আর অল্প সময়ে ইতোমধ্যে তারা গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করতেও সক্ষম হয়েছেন। কথা হয়েছে বিক্রয়বাজারডটকম-এর তিন প্রধানের সাথে।
‘সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছিল তখন, একটা ব্যবসায় লস দিয়ে যখন দিশেহারা। এমন সময় নতুন ব্যবসার কথা চিন্তা করছিলাম, সেই মুহূর্তে ই-কমার্সের কথা মাথায় আসে, তখন ই-কমার্স থেকে নিয়মিত কেনাকাটা করতাম। প্লান আসে ওখান থেকেই। ভাবার সাথে সাথেই কাজ শুরু করি, তখন পুঁজি বলতে ছিল শুধু নিজের ইচ্ছাশক্তি আর অদম্য আগ্রহ। আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সঙ্গী ছিল ছোটবেলার বন্ধু নাজিম উদ্দিন রাপ্পি। ২০১৫ সালের ১৭ মার্চ ই-কমার্সের প্ল্যান মাথায় আসে, ওই দিন রাতেই একটা ফেসবুক পেইজ খুলে কাজ শুরু করি মাত্র দুই হাজার টাকা নিয়ে। পরের দিনই একটা অর্ডার পাই, যা ডেলিভারি করতে আমার ৬ হাজার টাকার প্রয়োজন ছিল। এক মামার থেকে বাকি টাকা নিয়ে প্রথম ডেলিভারিটা সম্পূর্ণ করি, প্রথম দুই সপ্তাহে যে পরিমাণ লাভ হয় তা দিয়ে ডোমেইন নিয়ে ওয়েবসাইটের কাজ শুরু করি। পয়লা এপ্রিল ২০১৫ থেকে বিক্রয়বাজার নিয়ে পুরোদমে কাজ শুরু করি।’ এভাবেই শুরুর গল্প বলছিলেন বিক্রয়বাজারডটকম-এর সিইও নুরুন নবী হাসান। তার পড়াশোনা শেষ না হওয়ায় তখন ঢাকার বাইরে থেকেই তাকে ব্যবসা চালিয়ে যেতে হয়, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে পরে আগস্টে ঢাকায় এসে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর প্রেসিডেন্ট রাজিব সাহেবের পরামর্শে নতুনভাবে বিক্রয়বাজারকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। নুরুন নবী হাসান বলেন, ঢাকায় অফিস নিয়ে কার্যক্রম পূর্ণমাত্রায় শুরু করা জরুরি হয়ে পড়ে, প্রয়োজন ছিল মূলধনের। মূলধন জোগাড় করার জন্য থমকে দাঁড়াতে হয়নি আমাকে। আমার পরিকল্পনা শুনে মূলধনের পুরো টাকার ব্যবস্থা করেন ঘনিষ্ঠ বড় ভাই আলাউদ্দিন আদর। এছাড়াও তিনি সার্বক্ষণিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেন। এরপর পূর্ণ উদ্যোম নিয়ে কাজ শুরু করি। যার দরুন আমাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক নাজিম উদ্দিন রাপ্পি বলেন, বাংলাদেশে ই-কমার্সকে মানুষের দৌরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য বিক্রয় বাজার.কম নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জেলাগুলোতেও বিক্রয় বাজার.কম-এর শাখা অফিস থাকবে।
এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম আরেকজন পরিচালক আলাউদ্দিন আদর বলেন, ‘আমাদের স্বপ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের অনলাইন কেনাকাটায় বিক্রয়বাজার যেন বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান হতে পারে।’ আর নতুনদের উদ্দেশ্যে তিনি পরামর্শ দেন যে, যারা ই-কমার্সে আসতে চায় তারা যেন জেনে-বুঝে আসে। চাইলে পড়াশোনা করার পাশাপাশি এ ব্যবসা শুরু করার সুযোগ রয়েছে। যেমনটি আমরা করেছি। এছাড়া আরো বলেন, নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলাদেশে ই-কমার্সের ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল। ই-কমার্সের মাধ্যমে লাখ লাখ বেকারের কর্মসংস্থান হবে এমনটাই আশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন