রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকা গুলশানের আর্টিজান বেকারি ও রেস্টুরেন্টে নজিরবিহীন সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের শোকাবহ পরিবেশ অব্যাহত থাকতে থাকতেই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসীদের ককটেল হামলায় দু’জন পুলিশসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। শোলাকিয়ার ঐতিহ্যবাহী ঈদের জামাতের প্রাক্কালে ঈদগাহ ময়দানের এক কিলোমিটার অদূরে সন্ত্রাসীরা প্রথমে ককটেল হামলা চালায়। টহলরত পুলিশ তাদের ধাওয়া করলে সন্ত্রাসী-পুলিশ গুলি বিনিময় হয়। এ ঘটনায় দু’জন পুলিশ ও একজন গৃহবধূ নিহত হন। একজন হামলাকারীও নিহত হয়। আহত হয় পুলিশসহ ১২ জন। সন্দেহভাজন দু’জনকে আটক করে পুলিশ। উল্লেখ করা যেতে পারে, গুলশানের রেস্টুরেন্টে হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনায় দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। একই সঙ্গে ৭ জন ইতালীয়, ৯ জন জাপানি ও একজন ভারতীয় নাগরিক নিহত হন। গুলশান ম্যাসাকারের পর সারাদেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। বিশেষ করে দেশের সব ঈদ জামাতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যেই শোলাকিয়ায় বর্বরোচিত হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। ঘাতক-সন্ত্রাসীরা কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, এ ঘটনায় তা বিশেষভাবে উপলব্ধি করা যায়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ঈদের জামাতে সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটলেও পরবর্তীতে এরকম ঘটনা আর ঘটেনি। ঈদ বাংলাদেশের মানুষের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। নামাজ, ইবাদত-বন্দেগী, সম্প্রীতি, সহৃদয়তা ও আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে এদেশে দিবসটি উদযাপিত হয়। এমনি একটি পবিত্র অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ করে বিশেষ করে ঈদের জামাতকে নিশানা বানিয়ে সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটানো কত বড় দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক ঘটনা, সহজেই তা অনুমেয়। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। হামলাকারীদের ধিক্কার জানানোর ভাষা আমাদের নেই। আমরা দুই পুলিশ ও একজন নিরীহ নাগরিকের নিহত হওয়ার ঘটনায় গভীর শোক জ্ঞাপন করছি। তাদের পরিবার-পরিজনের প্রতি জানাচ্ছি গভীর সমবেদনা।
গুলশানের রেস্টুরেন্টে হামলা ও হত্যাকা- এবং শোলাকিয়ায় হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। গত কিছুদিনে টার্গেটেড কিলিংয়ের যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেসব ঘটনাকেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করা যায় না। টার্গেটেড কিলিংয়ের ঘটনায় এ যাবৎ অর্ধশত মানুষ নিহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন বিদেশী নাগরিক, বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক, প্রকাশক ও ব্লগ-লেখক। প্রথম দিকের ঘটনাগুলোকে সরকারি মহল থেকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলেও পরবর্তীতে স্বীকার করে নেয়া হয়, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পরিকল্পিত ঘটনা। আরো বলা হয়, একের পর এক পরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিসারী এসব ঘটনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সরকার হটানো, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট এবং দেশের ভাবমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করা। এসব হামলা ও হত্যাকা-ের সঙ্গে দেশী-বিদেশী চক্র জড়িত। দেশী-বিদেশী কারা এর সঙ্গে জড়িত আজ পর্যন্ত অবশ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা বের করতে পারেনি। হামলা ও হত্যাকা-ের কোনো ঘটনারই তদন্ত সম্পন্ন হয়নি। সন্দেহভাজন বলে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় তদন্ত কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে প্রতিটি সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের পরপরই সরকারি মহল থেকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দিকে আঙুল তোলা হয়েছে। বিরোধী দলের তরফেও এ জন্য সরকারকে দায়ী করা হয়েছে। এভাবে রাজনৈতিক ব্লেম গেমের কারণে প্রকৃত তথ্য ও সত্য বেরিয়ে আসেনি। জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তির পাশাপাশি অনিরাপত্তাবোধ ও হতাশা বিস্তৃত হয়েছে। অব্যাহতভাবে সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনায় জনগণের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টি হচ্ছে। বাস্তবে প্রমাণিত, ন্যূনতম নাগরিক নিরাপত্তাও দেশ থেকে উধাও হয়ে গেছে।
দেশ যে এক কঠিন ও অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসীদের যারা নিহত হয়েছে, কিংবা সন্দেহভাজন বলে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা সবাই এদেশের নাগরিক। তারা হোম গ্রোন সন্ত্রাসী। এটা একটা বিশেষ উদ্বেগের কারণ যে, সমাজের মধ্যেই এমন অবস্থা ও পরিবেশ বিদ্যমান রয়েছে যেখানে সন্ত্রাসী তৈরি হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে লাগাতারই বলা হচ্ছে, সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনার সঙ্গে আইএস বা ওই ধরনের কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের কোনো সংশ্রব বা সংযুক্ততা নেই; যদিও বেশ কিছু ঘটনার দায় আইএস, আল-কায়েদা স্বীকার করেছে। এমনও হতে পারে, ওই সব আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে বা সূত্রে দেশীয় সন্ত্রাসীদের সম্পর্ক থাকতে পারে। সম্ভাবনার এই দিকটিও এখন পর্যন্ত বের করা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো অনেকদিন ধরেই দাবি করে আসছে, বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব বা তৎপরতা রয়েছে। সরকার শুরু থেকেই এ দাবি অস্বীকার করে আসছে। আইএসের অস্তিত্ব ও তৎপরতা এদেশে নেই বলে আমরাও বিশ্বাস করি। এই সঙ্গে এ-ও আমরা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি যে, দিনকে দিন সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে পারে না। যে কোনো মূল্যে সন্ত্রাসীদের রুখে দেয়া এ মুহূর্তে প্রধান জাতীয় কর্তব্য। সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনায় দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা পরিস্থিতিরই ক্রমাবনতি ঘটছে না, একই সঙ্গে বিনিয়োগ, উন্নয়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মারাত্মক প্রভাবের আশঙ্কা বাড়ছে। দেশের ভাবমর্যাদা অবনত হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতা জরুরী। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এর মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য ও ঐক্যবদ্ধ ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সরকার তার আহ্বানে সাড়া দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। দেশ যখন বিপদে তখন এ ধরনের একতরফা মনোভাব ও চিন্তার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করা উচিত। সন্ত্রাস মোকাবিলায় ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ সহযোগিতা প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সরকার এ ব্যাপারেও খুব একটি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সরকার বরং ভারতমুখী নীতিতে অটল থাকার প্রবণতাই প্রদর্শন করছে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা। ভারতীয় গোয়েন্দারা এ ব্যাপারে বিশেষ কিছু করতে পারবে বলে তারা মনে করেন না। তাদের মতে, বাংলাদেশের গোয়েন্দারা ভারতীয় গোয়েন্দাদের চেয়ে সবদিক দিয়েই চৌকস ও পারঙ্গম। ভারতীয় গোয়েন্দাদের সহযোগিতা নেয়া হলে একদিকে দেশের গোয়েন্দাদের মধ্যে যেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তেমনি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী যে ক্ষোভ আছে, তাও বেড়ে যেতে পারে। সরকারকে এ বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে। সন্ত্রাসের মূল উৎস সন্ধানে আমাদের গোয়েন্দারাই যথেষ্ট। তাদের রাজনীতি নিরপেক্ষভাবে কাজে লাগাতে হবে। দরকার হলে সাবেক গোয়েন্দাদের এ কাজে সংযুক্ত করা যেতে পারে। এরপরও যদি প্রয়োজন হয় তাহলে বিদেশী গোয়েন্দাদের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে সম্মিলিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সরকার সেদিকে আশু দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে, এটাই কাম্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন