রেজাউল করিম রাজু : ঈদুল ফেতর মানে উৎসব আর আনন্দ মহামিলন সৌহার্দ্য। এক মাস রোজার পর শাওয়ালের চাঁদ দেখে ধনী গরীব নির্বিশেষে সকল মানুষের অন্তর আনন্দে ভরে ওঠে। গুনগুনিয়ে ওঠে ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ।’ ঈদের খুশী সবার সাথে ভাগাভাগি করার জন্য দীর্ঘ এগারো মাস অপেক্ষা। উচ্চ বিত্তদের বিলাসী আয়োজনের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত সবাই চিরচেনা টান পোড়নের সাথে সাধ আর সাধ্যের সমন্বয় ঘটিয়ে তাদেরও ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার কমতি ছিল না। জীবন-জীবিকার সন্ধানে নিজ শেকড় ছেড়ে দেশের এ প্রান্ত হতে ও প্রান্তে যাওয়া। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশে। যান্ত্রিক জীবনে আবদ্ধ হওয়া মানুষ এ সময়টার অপেক্ষায় থাকে। ছুটে আসে শেকড়ের কাছে। পথের কা¬ন্তি ভুলে গ্রামের সবুজ ক্ষেতের ধারে দাঁড়িয়ে নির্মল বাতাসে বুকভরা শ্বাস নিয়ে ময়লা ধরা ফুসফুসটাকে একটু রিচার্জ করে। এবার লম্বা ছুটি থাকাতে আসার প্রবণতাটা ছিল অন্যবারের চেয়ে বেশি। তাইতো ব্যস্ততম শহর নগরগুলো ছিল বেশ ফাঁকা ফাঁকা। গাঁয়ে ফিরে স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবদের কাছে পেয়ে কি যে আনন্দ তা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। গাঁও-গ্রাম যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। গাঁয়ে কষ্টে থাকা মানুষগুলো যেন ক’টাদিন তাদের কষ্ট ভুলে ছিল। একে অপরকে কাছে পেয়ে কত কথা, কত গল্প তার ইয়াত্তা ছিলনা। সবার মুখে কথার খৈ ফুটেছিল। ব্যক্তিগত খবরাখবর থেকে সমাজ, রাজনীতি, আশা-নিরাশা সবই ছিল। তবে আলাপচারিতার ফাঁকে ফাঁকে দেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুঃখজনক ঘটনা নিয়ে আলোচনা ছিল বেশী। সামনের দিনের অজানা আশংকা কম ছিলনা। সবার কন্ঠে ছিল এমন অবস্থা থেকে আল্লাহপাক যেন আমাদের হেফাজত করেন। ঈদের পরের ক’টা দিন ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করেছেন অনেকে। বিয়ে শাদীসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান এমনকি জমিজমার বিবাদ নিয়ে আলাপ-আলোচনার কমতি ছিলনা। কারণ এই একটা সময় সবাইকে কাছে পাওয়া যায় বলে। বড়রা এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও যুব-কিশোর-তরুণ-তরুণীরা মেতে উঠেছিল অন্যরকম আনন্দে। গ্রামে থাকা দাদা-দাদী, নানা-নানী, খালা-ফুফুদের আদর আপ্যায়নে। ছেলে মেয়ে, নাতী নাতনীরা আসবে বলে দাদী নানীরা আগে থেকে একটু একটু করে সব গুছিয়ে রেখেছিল। বড় বড় হাঁস, রাজহাঁস, দেশী মোরগ, মুরগী, পুকুরে বড় মাছ। আর এখনতো পাকা তালের মওসুম। তালের কত রকমের পিঠা পায়েস। আর টাটকা শাক সব্জীতো রয়েছে। সব ফরমালিনমুক্ত। পুকুরে বড় বড় মাছ ধরার দৃশ্য মুঠো ফোনে ধারণ করে অন্য বন্ধুদের পাঠিয়েছে। অনেকে পুকুরে নেমে ডুব সাঁতার খেলেছে। যারা সাঁতার জানে না তারা পাড়ে বসে হাততালি দিয়েছে, ছবি তুলেছে। লাউ কুমড়ো শসা করল্লার মাচার নীচে দাঁড়িয়ে কত সেলফী তুলেছে তার ইয়াত্তা নেই। যদিও বৃষ্টি তাদের চলা ফেরায় কিছুটা বিঘœ ঘটিয়েছে। বর্ষায় মেঠোপথ চলতে গিয়ে কেউ কেউ পা পিছলে কাদায় লুটোপুটি খেয়েছে। অন্যরা তা দেখে কম হাসাহাসি করেনি। এ প্রজন্মের তরুণরা কাদায় লুটোপুটি খেয়ে আনমনে গুনগুনিয়েছে ‘ও আমার দেশের মাটি........তুমি মিশেছো মোর দেহের সনে।’
শহর নগর ছেড়ে মানুষ গেলেও আবার এখানেও এসেছে। নিজ শহরে ফিরে এসে ছুটেছে বন্ধু-বান্ধবদের খোঁজে। তারুণ্য ভরা দিনগুলো যেসব আড্ডায় কেটেছে সেসব মোড়ে। মোবাইলে আগেভাগে খবর দিয়েছে চলে আসার জন্য। যদিও প্রায় কথা হয়। তারপর একেবারে সামনা সামনি পেয়ে কি যে আনন্দ। স্থানীয় ভাষায় বলে উঠেছে ‘কিরে মামুর বেটা তোর খবর কি ? তোকে যে একবারে পাঁচাই যাচ্ছেনা (চেনা)।’ কথার পর কথা দিয়ে চলে একে অপরকে নাড়ানাড়ি। বিনিময় হয় সুখ-দুঃখের কথা। বরাবরের মত ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের প্রাক্তন ছাত্ররা ঈদের পরের দিন বিকেলে মিলেছিল স্কুল প্রাঙ্গণে। সে এক অন্যরকম দৃশ্য। ১৯৪৪ সালে মাধ্যমিক পাসকরা ছাত্রটি যেমন এসেছিল তেমনি উপস্থিতি ছিল সদ্যপাস করাদের। প্রবীণ আর নবীনের মিলন মেলা বসেছিল। ঈদের রেশ কাটতে না কাটতে বেজে উঠেছে বিদায়ের করুণ সুর। ফের ফিরে যাওয়া শুরু হয়েছে জীবন যুদ্ধের কর্মস্থলে। গ্রামের স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় মনে মনে অনেকে গুনগুনিয়ে উঠছেন আবার হবে গো দেখা। এ দেখাই শেষ দেখা নইগো। অশ্রু সজল নয়নে বিদায় জানাচ্ছেন গাঁয়ে থাকা মুরব্বীরা। বলছেন ভাল থাকিস।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন