বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদের বিস্তার বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশে দেশে সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের যে তা-ব প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে তার জন্য দায়ী মূলত যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য ও তাদের মিত্র দেশগুলো। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় মিত্র দেশগুলো আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসনে শামিল হয় তার সঙ্গে। প্রথমবারের মতো তাদের সম্মিলিত সামরিক হামলার সম্মুখীন হয় আফগানিস্তানের মতো একটি দুর্বল দেশ। এর পরবর্তী ইতিহাস সকলের জানা। দেশটি মূলত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সেই আগ্রাসনের জের এখনো চলছে। এরপর ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলো একজোট হয়ে ইরাকের ওপর সামরিক আগ্রাসন চালায় এই অজুহাতে যে, সে দেশে মানববিনাশী অস্ত্র আছে যা বিশ্বশান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ। ওই আগ্রাসনের ফলে ইরাকও কার্যত অকার্যকর, বিশৃঙ্খল ও ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটের পরপর দু’টি মুসলিম রাষ্ট্রে আগ্রাসন ও দখল প্রতিষ্ঠার নানা প্রতিক্রিয়া বিশ্বব্যাপী প্রতিফলিত হয়েছে। সন্ত্রাসবাদের উত্থান ও বিস্তার তার মধ্যে অন্যতম। সেই শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন মহল থেকে বহুবারই বলা হয়েছে, আফগানিস্তান ও ইরাকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিচক্রের আগ্রাসন ও দখল প্রতিষ্ঠার পেছনে যৌক্তিক ও বিশ্বাসযোগ্য কোনো কারণ ছিল না। একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে ও মতলবে দেশ দু’টির ওপর সামরিক হামলা, আগ্রাসন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আফগানিস্তান ও ইরাকে হামলার বিষয়ে যতই যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করুক না কেন, তা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি, ধোপে টেকেনি। মতলবী অজুহাত ও মিথ্যা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দেশ দু’টিতে হামলা চালানো হয়, এই সত্যের এখন পর্যন্ত কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। ইরাকে হামলার ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের যৌক্তিকতা অনুসন্ধান ও তৎকালীন টনি ব্লেয়ার সরকারের ভূমিকা তদন্তে গঠিত চিলকট কমিটির সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, অসত্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাজ্য ওই হামলায় জড়িয়েছিল।
২০০৯ সালে স্যার জন চিলকটকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের যে কমিটি সরকারিভাবে গঠন করা হয় সেই কমিটি নয় বছর পর রিপোর্ট পেশ করেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে এবং বিস্তারিত পরিস্থিতি অনুধাবন না করেই ইরাকে হামলা চালানোর ঘটনা ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এবং যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বড় ধরনের ক্ষতিসাধন করেছে। সেই সঙ্গে ইরাকসহ ওই অঞ্চলের দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরাকে তৎকালীন শাসক সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন যে, সাদ্দাম ইরাকে রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদ গড়ে তুলেছেন এবং সাদ্দাম হোসেন বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ইরাকে হামলার উদ্যোগ নেয় বুশ সরকার। যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার একই দোহাই দিয়ে ইরাকে হামলা চালাতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনুমোদন নেন। রিপোর্টে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, সাদ্দাম হোসেনকে নিরস্ত্র করতে কিংবা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার শান্তিপূর্ণ উপায়গুলো পাশ কাটিয়ে ইরাকে হামলা চালানো হয়। ওই সময় ইরাকে হামলা করা ‘শেষ অবলম্বন’ বা ‘অনিবার্য’ ছিল না। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধিকাংশ সদস্যই চেয়েছিল হামলা না চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনের প্রতি চাপ অব্যাহত রাখতে। ইরাকের কাছে থাকা অস্ত্র বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি, এমন বিবেচনা ছিল ভিত্তিহীন। রিপোর্ট মোতাবেক, ইরাক যুদ্ধে ১৭৯ জন ব্রিটিশ সৈন্য নিহত হয়। সরকারের ব্যয় হয় প্রায় ১০ বিলিয়ন পাউন্ড। যুদ্ধে প্রায় দেড় লাখ ইরাকি নিহত ও ১০ লাখের বেশি বাস্তুহারা হয়। রিপোর্টে এ-ও জানানো হয়েছে, সরকার এই হামলার যে লক্ষ্য অর্জনের কথা বলেছিল তা অর্জন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্লেষক-পর্যবেক্ষকরা সবাই একমত যে, আফগানিস্তান ও ইরাকে সামরিক আগ্রাসন ও দখল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রই প্রধানত দায়ী। তার নীলনকশা অনুযায়ীই হামলা ও আগ্রাসন চালানো হয়। যুক্তরাজ্য ও অন্য মিত্ররা তাকে নিঃশর্ত সমর্থন জানায়, হামলায় অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীকালে লিবিয়া, সিরিয়াসহ ওই এলাকার রাষ্ট্রগুলোতে যা কিছু ঘটেছে ও ঘটছে তার জন্যও যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য ও তাদের মিত্ররাই দায়ী। সাম্রাজ্যবাদী এই শক্তিচক্র মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে যুদ্ধ, হানাহানি ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দিয়েছে, মানবিক মহাবিপর্যয় সৃষ্টি করেছে এবং রাষ্ট্রগুলোকে ব্যর্থ ও অকার্যকর করে দিয়েছে। এরই অনিবার্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে আইএসের কর্মকা- নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার অন্ত নেই। কারা এ সংগঠন গড়ে তুলেছে, কারা একে মদদ ও সহযোগিতা দিচ্ছে সে আলোচনার পাশাপাশি একে নির্মূল করার বিশ্বব্যাপী আয়োজন, তোড়জোড় ও তৎপরতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেকেই মনে করেন, আইএস বলে কথা নয়, সৃষ্ট বাস্তবতায় অন্য নামেও এ ধরনের সংগঠন গড়ে উঠতে পারত। প্রশ্ন হলো, কেন আইএস বা এরকম সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে উঠল বা উঠতে পারল? এর মূল অনুসন্ধান করতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আইএস বা অনুরূপ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো গড়ে ওঠার পেছনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিচক্রের হামলা, আগ্রাসন, অপকর্ম ও মানবতাবিরোধী অপরাধই দায়ী। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন, ইরাকী সেনাবাহিনী নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভুল সিদ্ধান্তের ফসল আইএস। তার এ মন্তব্যও প্রণিধানযোগ্য। তাই সন্ত্রাসবাদের হুমকি থেকে বিশ্বকে নিরাপদ রাখতে হলে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে ধ্বংস করার চক্রান্ত ও হেট মুসলিম ক্যাম্পেইন থেকে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য ও তাদের মিত্রদের সরে আসতে হবে। সন্ত্রাস ও যুদ্ধকবলিত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর জনগণকে তাদের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণের সুযোগ করে দিতে হবে। জনগণ ক্ষমতায়িত হলে সন্ত্রাসবাদী শক্তির অনিবার্য পরাজয় ঘটবে। সন্ত্রাসবাদের উত্থানের কারণ যথাযথভাবে শনাক্ত না করে তা উৎপাটনের যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, তা সফল হবে না। এটা সত্য, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য ও তার মিত্ররা যে লক্ষ্য অর্জন করতে চেয়েছিল তাতে তারা সম্পূর্ণই ব্যর্থ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নি সরকারগুলো উৎখাত করে নিজেদের পছন্দমতো সরকার গঠনে তারা ব্যর্থ হয়েছে। এই সঙ্গে তারা বিশ্বকে সন্ত্রাসবাদের হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তারাও আর আজ নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছে না। চিলকট রিপোর্ট প্রকাশের পর প্রশ্ন উঠেছে, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে টনি ব্লেয়ারের বিচার করা হবে কি না। অনেকেই বলছেন, তাকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হতে পারে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এ ব্যাপারে একটি প্রস্তাব আনার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো গেলে কিছুটা হলেও সান্ত¦না খুঁজে পাওয়া যাবে। একই অপরাধে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশেরও বিচার হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্র কি তেমন কোনো উদ্যোগ নেবে? নেয়া উচিত এ কারণে যে, ভবিষ্যতের জন্য তা একটা শিক্ষা হয়ে থাকবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন