মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

ব্যভিচার রোধে ইসলাম কী বলে

এসএম আরিফুল কাদের | প্রকাশের সময় : ৬ মার্চ, ২০২০, ১২:০৩ এএম

এমন দিন সম্ভবত খুব কমই আছে, যেদিন পত্র-পত্রিকায় ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশিত হয় না। উদ্বেগজনকহারে তা বেড়েই চলেছে। কিছু ঘটনা আছে, যা রীতিমতো লোমহর্ষক। ঘর-বাড়ি, পথ-ঘাট এমনকি শিক্ষাঙ্গনে পর্যন্ত এই জাহেলিয়াত থাবা বিস্তার করেছে। শিশু-বৃদ্ধা কেউই এই পাশবিকতার হাত থেকে নিরাপদ নয়। পাশাপাশি মিডিয়ার আড়ালেও চলছে যুবক যুবতীদের অবাধ যৌনকর্ম। এই মুহূর্তে তা প্রতিরোধ করতে না পারলে সামনে মহামারীর পাশাপাশি নারীজাতির মর্যাদা এতটাই ক্ষুন্ন হবে যা প্রাক-ইসলামি যুগকেও হার মানাবে। আর তা সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করা যাবে একমাত্র ইসলামি অনুশাসনকে ব্যবহার করে। অনুশাসনকে কাজে লাগাতে পুরুষের পাশাপাশি নারীগণও তা অনুসরণ বাঞ্ছনীয়। সেজন্যই নারী পুরুষ উভয়কেই সতর্কতামূলক আল্লাহর বানী ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয়ই তা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ। (সূরা বনী ইসরাঈল : ৩২) আল্লাহর ঘোষিত বানী অনুযায়ী ধর্ষণ বা ব্যভিচার অকল্যাণ থাকায় তা থেকে বাঁচার কৌশলও শিখিয়েছে ইসলাম।

পঞ্চেন্দ্রিয় হেফাজত করা : পঞ্চইন্দ্রিয় মানে হলো চোখ, কান, নাক, জিহবা ও চামড়া। ব্যভিচার প্রথমত শুরু হয় চোখের কার্যক্রম দিয়ে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে নবি (সা.) আপনি মুমিন পুরুষ ও নারীদের বলে দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টিকে নত রাখে....। (সূরা নূর : ৩০-৩১) শয়তানের বিষমাখা তীরগুলোর মধ্যে দৃষ্টিও একটি তীর। এ তীর নিয়ন্ত্রণ করা মানুষের জন্য খুবই কঠিন কাজ। কারণ, এতে প্রবৃত্তির লালসাই কার্যকরী ভূমিকা রাখে। এ কারণে রাসুল (সা.) চোখের দৃষ্টিকে আনত করার জন্য উম্মতের ওপর বিশষভাবে তাগিদ করেছেন। ‘হজরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে হঠাৎ দৃষ্টি (অশ্লীলতায়) পড়ে যাওয়ার ব্যপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, সাথে সাথেই দৃষ্টি সরিয়ে নেবে।’ (সহিহ মুসলিম : ৫৩৭২)
দৃষ্টি যেমন ধর্ষণ বা ব্যভিচার করতে অনুপ্রেরণা জোগায়, ঠিক তেমনি বাকী চারটি অঙ্গও তা থেকে কম নয়। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘চোখের ব্যভিচার হলো চোখ দিয়ে (অশ্লীল) দেখা, কানের ব্যভিচার হলো কান দ্বারা (অশ্লীল) শোনা, জিহবার ব্যভিচার (অশ্লীল) কথা বলা, হাতের ব্যভিচার হাত দ্বারা (কামভাবের সাথে অপরকে) স্পর্শ করা, পায়ের ব্যভিচার (কামভাবের সাথে) পথচলা এবং মনের ব্যভিচার কামনা-বাসনার কল্পনা করা। আর যৌনাঙ্গ তা সত্য অথবা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।’ (সহিহ মুসলিম : ৬৯২৫)
পর্দা করা : নারীদের ইভটিজিং, ধর্ষণ বা ব্যভিচার থেকে হেফাজত রাখতে এমনসব জায়গায় পর্দা করতে হবে যার দরুণ পরপুরুষরা দেখতে না পারে। পর্দাহীন চলাফেরায় কোনো নিরাপত্তা কখনো কেউ দিতে পারে না। কিন্তু ইসলামই পারে একজন পর্দানশীন নারীকে হেফাজত করার গ্যারাণ্টি দিতে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবি (সা.)! আপনার স্ত্রী, কন্যা ও মুসলিম নারীদেরকে বলুন, তারা যেন সকলে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মাথার উপর তাদের চাদর ঝুলিয়ে দেয়। এভাবে বের হলে তাদেরকে চেনা খুব সহজ হবে, ফলে কেউ তাদেরকে উত্ত্যক্ত করবেনা।’ (সূরা আহজাব : ৫৯)
প্রকৃত পর্দানশীন হতে প্রয়োজন পাতলা ও আঁটসাঁট পোশাক পরিধান থেকে বিরত থাকা। পাতলা ও আঁটসাঁট পোশাক যেমন পর্দা পালনে অবহেলা করা থেকে সতর্ক করা হয়েছে। তেমনি এর ভয়াবহতা ও সামাজিক ক্ষতিও সুস্পষ্ট। আর এ কারণেই তাদের ভোগ করতে হবে কঠিন শাস্তি। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘দুই শ্রেণির দোজখবাসীকে আমি এখনো দেখিনি। (অর্থাৎ পরবর্তী সময়ের সমাজে এদের দেখা যাবে) এক শ্রেণি হলো- ওই সব নারী, যারা পোশাক পরিধান করেও উলঙ্গ। যারা নিজেরা পথচ্যুত এবং অন্যদেরকেও পথচ্যুত করবে। এদের মাথা হবে উটের পিঠের চুটির মতো ঢং করে বাঁকানো। এরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের ঘ্রাণও তারা পাবে না।’ (সহিহ মুসলিম : ২১২৮)
সুগন্ধি ব্যবহার থেকে বিরত থাকা : নারীদের প্রতি পুরুষ অনেকসময় আকৃষ্ট হয় সুগন্ধি ব্যবহারের কারণে। আর সুগন্ধি মেখে বাহিরে বের হওয়ার ব্যাপারে কঠোরভাবে হুশিয়ার করেছে ইসলাম। বিশ্বনবী (সা.) ইরশাদ করেছেন- ‘যে নারী সুগন্ধি ব্যবহার করল, অত:পর লোকদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করল এ ধারণা নিয়ে যে, লোকেরা যেন তার সুঘ্রাণ পায়, তাহলে সে নারীব্যভিচারী।’ (সহিহ নাসাঈ : ৫১২৫)
কণ্ঠস্বর হেফাজত করা : যেসব কারণে নারী পুরুষের প্রতি এবং পুরুষ নারীদের প্রতি আকর্ষিত হয় তন্মধ্যে অন্যতম হলো মিষ্টি কণ্ঠে কথা বলা। মিষ্টি কথার কারণে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ জাগে। আর সেই জন্যই সর্বপ্রথম নারীদের কণ্ঠস্বর হেফাজতের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা (পর-পুরুষের সাথে) কোমলভাবে কথা বলো না। অন্যথায় যার অন্তরে ব্যাধি আছে সে লালায়িত হয়ে পড়বে।’ (সূরা আহজাব : ৩২) অনুরূপভাবে পুরুষরাও নারীদের সাথে মিষ্টি কথা না বলার নির্দেশ রয়েছে। ‘হজরত সাহাল ইবনে সাআদ (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের দুই চোয়ালের মধ্যস্থ অঙ্গ (জিহবা) এবং দুই রানের মধ্যস্থ অঙ্গ (লজ্জাস্থান) হেফাজত করবে আমি তার জান্নাতের জিম্মাদার।’ (সহিহ বোখারি : ৬৪৭৪) এখানে জিহবা হেফাজত বলতে বিভিন্ন ধরনের কথাকে বুঝানো হয়েছে। তন্মধ্যে অশ্লীল কথাও অন্যতম। আর তাই পুরুষও তার জবানকে নারীদের প্রতি আকর্ষিত করার মত কথা থেকে বিরত রাখতে হবে।
লজ্জাস্থান হেফাজত করা : ব্যভিচার বা ধর্ষণের সর্বশেষ অঙ্গ লজ্জাস্থান। পূর্বে উল্লেখিত অঙ্গসমূহ ব্যভিচার করতে উৎসাহিত করার পর তা কার্যকর করে লজ্জাস্থান। উল্লেখিত অঙ্গসমূহ যেমন হেফাজত করা আবশ্যক, তেমনি লজ্জাস্থানও হেফাজত করা আবশ্যক। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, হে নবি (সা.)! আপনি মুমিন নর-নারীদেরকে বলুন,...........তারা যেন তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এটা তাদের জন্য খুব পবিত্র পন্থা। (সূরা নূর : ৩০-৩১) অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চিত ভাবেই সফলকাম হয়েছে মুমিনরা.........যারা নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। তবে তাদের স্ত্রীদের ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে হেফাজত না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না। তবে যদি কেউ তাদের ছাড়া অন্য কাউকে (যৌন ক্ষুধা মেটাবার জন্য) কামনা করে তাহলে তারা হবে সীমালংঘনকারী। (সূরা আল মুমিনুন : ১-৭)
বিবাহ করা : যৌবনে যৌন ক্ষুধা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু হালাল হারামের বিষয়ে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। ইভটিজিং, ধর্ষণ ও ব্যভিচারমুক্ত দেশ গড়তে সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো বিবাহ করা। যার প্রমাণ মিলে রাসুল (সা.)-এর হাদিসে। বিশ্বনবি (সা.) ইরশাদ করেন, ‘হে যুব স¤প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে তারা যেন বিয়ে করে। কেননা, বিবাহ তার দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং (অবৈধ) যৌনতাকে সংযমী করে।’ (সহিহ বোখারি : ৪৬৯৬)
বিবাহিত পুরুষগণ ব্যভিচার বা ধর্ষণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে যখন কোনো নারীর দিকে কামভাবের নজর চলে আসে তাৎক্ষনিক স্বীয় স্ত্রীর নিকট থেকে যৌন চাহিদা মিটাবে। হাদিসে এসছে, ‘হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) হতে বর্ণিত। রাসুল (সা.) একটি স্ত্রীলোককে দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি (সা.) তাঁর স্ত্রী জয়নবের কাছে গেলেন। তখন তিনি এক টুকরা চামড়া পাকা করছিলেন। তিনি (সা.) তাঁর কাছ থেকে প্রয়োজন পূরণ করলেন। অতঃপর তিনি সাহাবাদের কাছে এসে বললেন, স্ত্রীলোক শয়তানের বেশে আগমন করে এবং শয়তানের বেশে চলে যায়। অতএব তোমাদের কারো দৃষ্টি স্ত্রীলোকের উপর পড়লে স্বীয় স্ত্রীর কাছে আসো। কেননা, এটইি তার অন্তরের কামনাকে দমন করতে পারে।’ (সহিহ মুসলিম : ৩২৭১)
রোজা রাখা : কোনো যুবক যদি বিবাহও করতে অসামর্থ্য হয় তাহলে তাকে নফল রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। ‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) আমাদের লক্ষ্য করে বলেন, হে যুব সমাজ! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে তারা যেন বিয়ে করে। কারণ তা দৃষ্টিশক্তিকে অধিক নিয়ন্ত্রণকারী এবং লজ্জাস্থানকে অধিক হেফাজতকারী। আর যাদের বিয়ে করার সামর্থ্য নাই তার কর্তব্য হলো রোজা রাখা। কারণ, এ অবস্থায় তার যৌন প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ রাখবে। (সহিহ মুসলিম : ৩২৬৩)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন