রাজনীতির ভাষা আর বাস্তবতার দেয়াল-লিখন কখনই এক নয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে বাম গণতান্ত্রিক বলয়ের রাজনীতিকরা মন্তব্য করেছেন, দেশে খুন, গুম ও সন্ত্রাসবাদের উত্থানের দায় সরকার এড়াতে পারে না। বিএনপির তরফে বলা হয়েছে, উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর অপতৎপরতার পথপ্রদর্শক হচ্ছে আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী। জঙ্গিবাদী অশুভ শক্তিকে এরা জিইয়ে রাখতে চাইছে। সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন বলেছে, উগ্রপন্থা ও জঙ্গিবাদের বিস্তার বিচ্ছিন্ন বা স্বতঃস্ফূর্ত কোনো ঘটনা নয়। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সুপরিকল্পিত, দীর্ঘ প্রস্তুতি এবং রাজনৈতিক হঠকারিতা ও অবিমৃশ্যকারিতা। এর শেকড় আজ অনেক গভীরে। এ থেকে উত্তরণের যে সংগ্রাম তাও হতে হবে সর্বাত্মক ও দীর্ঘমেয়াদি। জঙ্গিবাদের এ ভয়াবহ বিস্তারকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করে এ থেকে মুক্তির জন্য জাতীয় ঐক্য ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। গুলশান হামলা ও শোলাকিয়ার ঘটনার পরপরই আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এসব জামায়াত-শিবিরের কাজ বলে মন্তব্য করেন। মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ একই সুরে বলেন, শোলাকিয়া ঘটনা জামায়াত-শিবিরের কাজ হতে পারে। ভারতীয় মিডিয়ায়ও গুলশান ঘটনার নেপথ্যে বিএনপি-জামায়াত, বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, মীর কাসেম আলীর কর্মী-সমর্থক জড়িত উল্লেখ করে এ ঘটনায় ব্যবহৃত কূটনীতিকদের গাড়ি, নির্দিষ্ট অংকের টাকা ইত্যাদির এমন নিখুঁত বর্ণনা এসেছে যার পর আর বাড়তি তদন্ত বা অনুসন্ধানের প্রয়োজন পড়ে না। এসব মন্তব্য ও বিবরণ সত্য হলে মূল হোতাদের অবিলম্বে পাকড়াও করে সন্ত্রাসবাদ বন্ধ করাই মানুষের স্বাভাবিক কাম্য।
স্মর্তব্য যে, চারদলীয় জোট সরকারের সময় একই সাথে দেশের ৬৩ জেলায় সাড়ে পাঁচশ’ স্থানে বোমা হামলার নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে। জেএমবি নামক জঙ্গি সংগঠনের এটিই ছিল প্রথম ব্যাপক বহিঃপ্রকাশ। ঘটনার পরপরই ফরিদ উদ্দিন মাসুদ বিদেশে চলে যাওয়ার পথে বিমানবন্দরে গ্রেফতার হন। বোমা হামলার কয়েক দিন আগে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেন ও সংশ্লিষ্টদের সাথে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ এনে তাকে কয়েক মাস জেলে আটক রাখা হয়। তখন ফরিদ উদ্দিন মাসুদ বলেছিলেন, জামায়াতের নিজামী ও মুজাহিদকে রিমান্ডে নিলে বোমা হামলার রহস্য বের করা সম্ভব। সর্বশেষ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লক্ষাধিক আলেমের স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানের নেতৃত্ব দেন তিনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দাদের সহায়তায় এই ক্যাম্পেইন শেষ হলে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ আলেমদের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানান। অনেকেই মনে করেন যে, দেশের অধিকাংশ আলেম উলামা ও ধর্মপ্রাণ মানুষের বিরুদ্ধাচরণ করে ফরিদ উদ্দিন মাসুদ গণজাগরণ মঞ্চের সাথে সংহতি প্রকাশ করে এবং ইসলামবিরোধী নানা ইস্যুতে নতজানু, দরবারি এবং শরীয়তবিরোধী ভূমিকা রেখে ইতোমধ্যেই নিজেকে ধিকৃত, বিতর্কিত ব্যক্তিতে পরিণত করেছেন। এমনকি তাকে নিয়ে সরকারকেও নানা সময়ে বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়েছে এবং সর্বশেষ তিনি সরকারের জন্য সহায়কের চেয়ে বরং গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সরকার তাকে শোলাকিয়ার ইমাম হিসেবে পুরস্কৃত করলেও বিতর্কিত ও গণধিকৃত এই ইমামকে পাহারা দিতে শুরু থেকেই প্রশাসন, র্যাব-পুলিশ ও গোয়েন্দাদের এত বেশি ব্যবহার করতে হয়েছে, যা বাংলাদেশের কোনো ঈদ জামাতেই কোনো দিন করতে হয়নি। বিগত প্রায় দু’শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ মাঠের জন্যও এটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। বিগত ঈদের দিনে মূলত ইমাম ফরিদ উদ্দিন মাসুদকে প্রতিহত করতেই কি সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল কি না তাও খতিয়ে দেখার বিষয়। বিভিন্ন সময় দেশের সর্বজনমান্য আলেমদের অনেকেই মত প্রকাশ করে বলেছেন, লাখো মানুষের ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতির বিপক্ষে নির্লজ্জ দালালি আর দলকানা অন্ধ অনুগত চরিত্র নিয়ে নিজের আলেম ও ইমামসুলভ মর্যাদা যে নিজেই বিনাশ করে এমন ব্যক্তি কোনো সরকার বা দলের জন্য সম্পদ নয় বরং পরিণামে দায় হয়েই দেখা দেবে, এটাই স্বাভাবিক। সরকার যত তাড়াতাড়ি এ বাস্তবতা অনুধাবন করবে ততই মঙ্গল।
সন্ত্রাস মোকাবেলা বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু উদ্ভূত পরিস্থিতি বিষয়ে সরকারের কিছু সিদ্ধান্তের কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। এতে গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনায় জড়িত মূল হোতাদের মুখোশ উন্মোচন সম্ভব হবে কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, তদন্ত এগিয়ে চলেছে। অগ্রগতি সম্পর্কে এখন কিছুই বলব না। কারণ এতে সন্ত্রাসীরা সতর্ক হয়ে যাবে। সব রহস্য অচিরেই প্রকাশিত হবে। তিনি জুমায় খুতবা ও বয়ান মনিটর করার ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও সাংবাদিকদের জানান। সংবাদপত্র ও অন্যান্য মাধ্যমে সরকারের এ সিদ্ধান্ত প্রচারিত হওয়ায় দেশে ৯২ শতাংশ মুসলিম নাগরিকের ধর্মীয় অনুভূতি মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। প্রতিনিধিত্বশীল ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও নেতৃবৃন্দ তাদের অভিব্যক্তি নানাভাবে প্রকাশ করছেন। ধর্মীয় অঙ্গনের অনেকেই খেদোক্তি করেছেন যে, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ও স্বেচ্ছাচারের পরাকাষ্ঠার ফলে দেশে যে আর্থ-সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে তা মোকাবেলার চিন্তা না করে এবং শান্তিপূর্ণ দেশটিতে পরিদৃষ্ট ভয়াবহ সন্ত্রাস ও ভীতিময় পরিবেশ স্বাভাবিক করার উদ্যোগে আন্তরিক না হয়ে দায়িত্বশীলদের অনেকেই শুধু রাজনীতিই করে চলেছেন। পুলিশের আইজিপি তার পেশাদারিত্বের বাইরে গিয়ে হেফাজতকে খোঁচা মেরে বক্তব্য রাখায় হেফাজত ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফী ও মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী এর প্রতিবাদ করে সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, পুলিশের দায়িত্ব অপরাধীদের ধরে বিচারের মুখোমুখি করা। কোনো ধর্মীয় সামাজিক সংগঠনের বিরুদ্ধে অসত্য বক্তব্য দিয়ে ঘায়েল করা নয়। দেশের অসংখ্য ধর্মপ্রাণ বিশিষ্ট নাগরিক যে উদ্বেগের কথাটি মিডিয়াকে জানিয়েছেন সেটি হলো, অন্যায়-অনাচার, দুর্নীতি-সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় শত শত বছর ধরে দেশের যেসব ধর্মীয় নেতা ওয়াজ, বয়ান, জুমার খুতবা, মসজিদ-মাদরাসা ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণকে শান্তি, নেকি, সদ্ভাব ও সম্প্রীতির পক্ষে মোটিভেট করে বাংলাদেশকে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও শান্তি-শৃঙ্খলার রোল মডেলে পরিণত করলেন, ব্যর্থ নেতৃত্ব কেন কারণে-অকারণে বারবার শুধু সে ধর্মীয় অঙ্গনের প্রতিই অঙ্গুলি নির্দেশ করে? কোন বিবেচনায় অনেক নেতা, বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া ধর্মীয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দিকে বিভ্রান্তির তীর নিক্ষেপের প্রয়াস পায়? সরকারের মন্ত্রণালয়, ইসলামী ফাউন্ডেশন ও অন্যান্য মেশিনারি বিষয়ের গভীরে না গিয়ে এমন সব প্রস্তাব ও পরামর্শ নীতিনির্ধারকদের গেলায় যা হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। যেখানে ভারত আইএসসহ আন্তর্জাতিক বড় সব সন্ত্রাসী গ্রুপের হুমকি মোকাবেলা করতে নাকানিচুবানি খাচ্ছে সেখানেও মসজিদ, মাদরাসা, বয়ান ও জুমার খুতবার ওপর নজরদারি বা নিয়ন্ত্রণের কথা ওঠে না। শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে নির্দ্বিধায় সন্ত্রাসবাদের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে প্রকারান্তরে মসজিদ, মাদরাসা, জুমার খুতবা ও বয়ানকে সাব্যস্ত করা হচ্ছে। দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে এসব বলা হলে এর দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কল্যাণে তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এসব থেকে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ যে বার্তাটি পেয়ে থাকে তা কখনই সরকারের জন্য ইতিবাচক হতে পারে না। দোষারোপের রাজনীতি নয়, সরকার জাতীয় সঙ্কট নিরসনে আন্তরিক হবে, এটাই প্রত্যাশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন