রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

| প্রকাশের সময় : ১৭ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

আজ ১৭ মার্চ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিবস। ১৯২০ সালের এই দিনে তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গীপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতার নাম সায়েরা খাতুন। সৌভাগ্যবশত আজকের দিনটি তার জন্মের শতবর্ষপূর্তীর দিনও বটে। সরকার ইতোমধ্যে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ মুজিববর্ষ ঘোষণা করেছে। বছরজুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি ও অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে জাতির পিতাকে স্মরণ করা হবে। এমন এক সময় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী বা মুজিববর্ষ পালিত হচ্ছে, যখন তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশ পরিচালনা করছে। শেখ হাসিনার সরকার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজ করে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সবচেয়ে খ্যাতিমান, সবচেয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় নাম। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে তিনি স্বীকৃত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ অভিন্ন সূত্রে প্রথিত। বঙ্গবন্ধু না জন্মালে বাংলাদেশ নামের কোনো দেশ হতো কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এই অর্থেই বলা হয়, বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মানে বঙ্গবন্ধু। ব্যক্তিনাম ও দেশনাম এভাবে একাকার হয়ে যাওয়ার নজির বিশ্বে বিরল। তিনি ছিলেন জাতীয় জাগরণের তুর্যবাদক। জাতিকে উজ্জীবিত ও প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তার অবদান বলতে গেলে একক। তিনি ভাষাভিত্তিক ও জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে আমাদের অশেষ ঋণে আবদ্ধ করে গেছেন। আজ গভীর শ্রদ্ধায় ও কৃতজ্ঞতায় আমরা তাকে স্মরণ করছি।
বাংলাদেশ বাংলাভাষীদের স্বাধীন দেশ, বাঙালিরও একমাত্র স্বাধীন দেশ। এদেশের ৯২ শতাংশ মানুষ মুসলমান। অন্যরা অন্যান্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ। আমাদের জাতিসত্তার প্রধান দুটি উপাদানের একটি হলো বাঙালিত্ব অপরটি মুসলমানিত্ব। বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্বের মধ্যে কোনো বিরোধ বা পার্থক্য নেই। এরা একে অপরের পরিপূরক। নাগরিকত্বের পরিচয়ে আমরা বাংলাদেশি। বঙ্গবন্ধু বাঙালি ও মুসলমান দুটি পরিচয়কেই সমান মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদান করেছেন। বস্তুত: এই দুটি পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি জীবনব্যাপী সাধনা ও সংগ্রাম করেছেন। স্মরণ করা যেতে পারে, ব্রিটিশ ভারতে যখন মুসলমানরা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য দিক থেকে অত্যন্ত অবনত ও পিছিয়ে ছিল, তখন তিনি মুসলমানদের জাগরণ ও তাদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তার ‘অসমান্ত আত্মজীবনী’তে কেন মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রয়োজন, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘অখন্ড ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না, এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতাম।’ মুসলমানদের স্বতন্ত্র-স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় তিনি অক্লান্ত, শ্রম ও সংগ্রাম করেন, এমন কি জীবনের ঝুঁকি পর্যন্ত নেন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরে তিনি লক্ষ করেন তৎকালীন পূর্ববঙ্গ কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনী হয়ে উঠছে। লক্ষণটা শুরুতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে শাসকদের বিরূপ মনোভাবের মধ্য দিয়ে। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উপেক্ষিত হলে শুরু হয়ে যায় ভাষার দাবিতে আন্দোলন। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাঝামাঝি সময়ে এ আন্দোলন শুরু হয়। ৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গুলি চলে এবং সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ শাহদাত বরণ করেন। বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার ও মুক্তির কোনো পথ নেই। এটা সবচেয়ে আগে এবং সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝেন বঙ্গবন্ধু। পরবর্তীকালের সকল আন্দোলন সংগ্রাম এই লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছে এবং সব আন্দোলনেরই নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তার ৬ দফা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দিগদর্শন। এ আন্দোলনের পথ ধরেই ৭০-এর নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে না পারলেও তার নামেই যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে এবং দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু দেশের হাল ধরেন। যুদ্ধবিধস্ত দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। শান্তিপূর্ণ, স্বয়ম্ভর, সমৃদ্ধ দেশ প্রতিষ্ঠার নতুন সংগ্রাম শুরু করেন। ‘সোনার বাংলা’ গড়া ছিল তার স্বপ্ন। আমাদের দুর্ভাগ্য, ঘাতকরা তার এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ দেয়নি। তাকে হত্যা করে বস্তুত তারা বাংলাদেশের আত্মকেই হত্যা করে। জাতীয় ইতিহাসে এর চেয়ে মর্মান্তিক, দুঃখজনক ঘটনা আর নেই।
বঙ্গবন্ধু অমর, চিরঞ্জীব। তার দেহ, তার জীবন্ত অস্তিত্ব আমাদের সামানে নেই বটে; তবে তিনি এদেশের সর্ব প্রজন্মের মানুষের চেতনায় ও হৃদয়ে স্থায়ী আসন পেতে বসে আছেন। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, এ জাতির একটি মানুষ যতদিন জীবিত থাকবে, তার নাম ততদিন বেঁচে থাকবে। বঙ্গবন্ধু নিজেকে বাঙালি হিসেবে যেমন গর্ব করতেন, তেমনি গর্ব করতেন মুসলমান হিসেবেও। তার পূর্ব পুরুষ একদা ইরাক থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য এদেশে আসেন। বলা বাহুল্য, একারণেই ইসলামের প্রতি তার বিশ্বাস ও অনুরাগ ছিল সহজাত। ৭০ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে এক বেতার ভাষণে তিনি বলেছিলেন: ‘আমরা বিশ্বাসী ইসলামের বিশ্বাসে। আমাদের ইসলাম হযরত রাসূলে কারিম (দ.) এর ইসলাম। যে ইসলাম শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের মন্ত্র।’ তিনি গর্ব করতেন এই বলে যে, ‘আমি মুসলমানের সন্তান মুসলমান।’ গর্বের সঙ্গে তার দেশের পরিচয় তুলে ধরতেন এভাবে: ‘বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র’। সাড়ে তিন বছরেরও কম সময় তিনি রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা করেন। এই সময়ের মধ্যে ইসলামের সেবায় তিনি ব্যাপক ভূমিকা ও অবদান রাখেন। তিনি মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে নীতিনির্দেশনা প্রদান করেন ও মাদরাসা খুলে দেন। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, মদ, জুয়া, হাউজি, ঘোড়দৌড় নিষিদ্ধ, কাকরাইল মারকাজ মসজিদ ও টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার জায়গা বরাদ্দ, ইসলামী বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন, হজপালনে সরকারি অনুদান প্রদান প্রভৃতির মাধ্যমে ইসলামের প্রতি তার অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্যের পরিচয় দেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রকৃতই জাতির নেতা ও পিতা। তিনি ছিলেন সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রসারণবাদ, আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসনবাদের বিরোধী, শোষণ-বঞ্চনা ও বৈষম্যের প্রতিবাদী। মানুষের স্বাধীনতায় তার বিশ্বাস ছিল দৃঢ়, রাষ্ট্র ও জাতির পূর্ণ বিকাশ ছিল তার আকাক্সক্ষার অন্তর্গত। বঙ্গবন্ধু আমাদের অনুপ্রেরণার আশ্রয়স্থল। যতদিন আমরা তার নীতি-আদর্শ ও কর্মের অনুসরণ করতে পারবো ততদিন আমাদের কেউ পদানত করতে পারবে না। আমরা আজকের এই দিনে তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। এই সঙ্গে আশা প্রকাশ করছি, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে জাতির অগ্রগতি ও প্রতিষ্ঠা তরান্বিত করবেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন