শিক্ষার্থীদেরকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধকরণের অভিযোগ তুলে নর্থসাউথসহ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের প্রস্তাব দিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সদস্য। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখনি কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিপক্ষে মত দিয়েছেন। নর্থসাউথে কারা কী পড়াচ্ছেন, কী করছেন, এসব বিষয়ে খোঁজখবর নেয়ার কথা বলেছেন। এক সময় জঙ্গিবাদের দায়ে কেউ কেউ মাদরাসা বন্ধ করে দেয়ার দাবি করলেও বাস্তবতা হচ্ছে জঙ্গিবাদের সাথে মাদরাসার সংশ্লিষ্টতা কোথাও পাওয়া যায়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সন্ত্রাসী-জঙ্গিবাদী ঘটনাগুলোতে ঢাকার অভিজাত এলাকার নামী-দামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষত অ্যাকাডেমিকভাবে সবচেয়ে সফল ও মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য সুখ্যাত নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির নাম ঘুরেফিরেই আসছে। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ২০ জন বিদেশীকে হত্যার দায়ে সন্দেহভাজনদের মধ্যেও নর্থসাউথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, স্কলাসটিকাসহ ঢাকার নামী-দামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ার সাথে সেই প্রতিষ্ঠানের কারিকুলাম, শিক্ষকম-লী বা শিক্ষা প্রশাসনের দায় কতটা তা পর্যালোচনার অবকাশ রয়েছে। এসব বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমনের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়।
দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো, অ্যাকাডেমিক কর্মকা-, শিক্ষার মান ও পরিচালনার স্বচ্ছতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন ও অভিযোগ রয়েছে। ইউজিসির নির্দেশনা ও নীতিমালা অমান্য করায় কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। তবে যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকেই সুনামের সাথে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে তার মধ্যে নর্থসাউথ অন্যতম। অন্যতম কিছু ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতার কথা বাদ দিলে নর্থসাউথ থেকে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী বেরিয়ে এসে দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মকা-ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। ইউরোপ-আমেরিকাসহ সারাবিশ্ব এই সঙ্কট মোকাবেলা করছে। ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের মানুষ নানাভাবে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ার মোটিভেশন পেতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সন্ত্রাসবাদ উত্থানের মূল কারণ বিশ্লেষণ, প্রতিকার ছাড়াও এবং পারিবারিক ও সামাজিক নজরদারিসহ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টিতে অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলার উদ্যোগ থাকতে হবে। দেশে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ শক্তিশালী হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতাকেও বিবেচনায় রাখতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের বিরুদ্ধেও জঙ্গিবাদসহ নানা রকম অসামাজিক ও অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িত থাকার প্রমাণ বিভিন্ন সময়ে পাওয়া গেছে। এ কারণে এসব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়ার কোনো চিন্তা বা প্রস্তাব কখনো আসেনি। এ ধরনের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্যও নয়।
ভারতীয় স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হয়ে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ কলুষিত হচ্ছে। কখনো কখনো এসব চ্যানেল বন্ধ করার জোরালো দাবিও উঠেছে। এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ না নিলেও জঙ্গিবাদে উসকানির অভিযোগ তুলে ইসলাম প্রচারভিত্তিক টিভি চ্যানেল পিস টিভি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এমনকি দেশের মসজিদগুলোতে জুমার খুতবার ওপর খবরদারির প্রস্তাবও দেয়া হচ্ছে। যেখানে গত ৭-৮ বছর ধরে দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রায় সবগুলো টিভি চ্যানেলেই সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম ও জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে, সেখানে কোনো অপপ্রচারে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব নয়। বিশেষত জুমার খুতবার মতো ধর্মীয় বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ ও নজরদারি কথিত জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধকরণ ঠেকাবে নাকি ধর্মপ্রাণ মানুষকে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে তুলবে সে বিষয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্যদিকে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ঠেকানোর নামে কোনো স্কুল, মাদরাসা বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের প্রস্তাবও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বন্ধ করা কোনো সমাধান নয়, শিক্ষা কারিকুলাম ও তরুণ শিক্ষার্থীদের সামাজিক-পারিবারিক পরিবেশের দিকেও নজর দিতে হবে। বিশেষত সামাজিক-রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ও বিপথগামিতার নেপথ্য কারণসমূহ দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে দ্রুত ও কার্যকরভাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন