দেশের অর্থনীতির প্রাণ সঞ্চারী খাতগুলো এখন মারাত্মক হুমকির মুখে। বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের প্রধান যোগান প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স কমেছে। সদ্য শেষ হওয়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রবাসীরা যে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়েছে তা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩৯ কোটি ডলার (প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা) বা দুই দশমিক ৫৫ শতাংশ কম। অন্য খবরে বলা হয়েছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে ঢাকার গুলশান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার পর পোশাক খাতের ক্রেতারা অনিরাপদ বোধ করায় তারা দেশের বাইরে পোশাক শিল্পের মালিকদের সাথে বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়ার ম্যানুফেকচার এন্ড এক্সপোর্ট এসোসিয়েশনের একজন নেতা একটি দৈনিককে জানিয়েছেন, ঢাকায় বিদেশী ক্রেতাদের বেশ কয়েকটি বৈঠক হবার কথা ছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেগুলো বাতিল করা হচ্ছে। তারা এখন দিল্লী ও হংকংসহ অন্য দেশে বসে ঢাকার বৈঠকগুলো শেষ করতে চাচ্ছে। তিনি মনে করেন, গুলশান হামলার ক্ষতি বিদেশীদের অন্যত্র চলে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করেছে। আগামীতেও করবে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। এদিকে ধারাবাহিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। উদ্বেগের অন্যতম কারণ হলো বিনিয়োগ স্থবিরতা। বলা হচ্ছে, আস্থার সংকটে পর্যাপ্ত বিনিয়োগযোগ্য তহবিল থাকলেও বিনিয়োগ বাড়ছে না। শতভাগ অর্থ খরচের পরিকল্পনা ও উদ্যোগ এবারেও ব্যর্থ হয়েছে। ঐদিকে কাজে আসেনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তদারকিসহ নির্দেশনা, সচিবদের সাথে প্রকল্প পরিচালকদের সমন্বয়, তিন মাস পর পর পর অগ্রগতি প্রতিবেদন, পিডিদের কাজের মূল্যায়নে পদোন্নতি, পরিকল্পনামন্ত্রীর গুচ্ছ পরিকল্পনা। বৃত্তে আটকা পড়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর বাস্তবায়ন।
যত কথা-বার্তাই বলা হোক, অনেকদিন থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর প্রধান কারণ আস্থার সংকট। এর সূত্র-উৎস নিয়ে নতুন করে আলোচনা না করলেও এটা বলা যায়, দেশের সকল সচেতন মহল জাতীয় স্বার্থে পরিস্থিতি উত্তরণের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করলেও সরকারের একগুঁয়েমি, এক শ্রেণৗর তোশামোদকারীর ভ-ামী এবং সরকারের কোন কোন মহলের ভিন্ন ব্যাখ্যার কারণে পরিস্থিতিতে কোন ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব হয়নি। অর্থনৈতিক বাস্তবতা তুলে ধরলেই তারা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির দিন দিনই উন্নতি হচ্ছে। এ যে এক ধরনের অতৃপ্তির মধ্যে তৃপ্তি পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা, সে কথাও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বার বার বলে আসছেন। দেশের অর্থনীতিকে কার্যকর বাস্তবতায় নিয়ে যেতে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকেও বারবার বলা হয়েছে ও হচ্ছে। বাস্তবত সরকারের কোন কোন মহল এক ধরনের পরিসংখ্যান তুলে ধরে জনগণ এবং সচেতন মহলকে বোকা বানাবার যে অপচেষ্টা করে আসছে সেই মুখোশই খুলে গিয়েছে প্রবাসী আয়ের হিসাবে। এক বছরের ব্যবধানে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্সে ধাক্কা লেগেছে। ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জনশক্তি রফতানীতে ধস, তেলের দরপতনের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর আর্থিক সক্ষমতা হ্রাস, বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের দেশে ফেরত আসা ও ক্ষুদ্র অঙ্কের প্রবাসী আয় হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসায় ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমেছে। একথা বোধহয় খুব অসংগত নয় যে, পরিস্থিতি যেদিকে এগুচ্ছে তাতে প্রবাসী আয়ে আরো ধস নামতে পারে। ইতোমধ্যেই চলমান হামলাগুলোতে বাংলাদেশীদের সম্পৃক্ততার কথা যেভাবে জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশীদের নিয়োগকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে। এদিকে কঠোর নিরাপত্তায় গত রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বিনিয়োগ নিয়ে উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছেন। বৈঠকের সূত্র উদ্ধৃত করে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বিনিয়োগের জন্য তহবিল নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা না থাকলেও দুশ্চিন্তা রয়েছে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট নিয়ে। বলা হচ্ছে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন নীতিমালা সহজ করলেও কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগ হচ্ছে না। এ সংশয় আরা বাড়িয়ে দিয়েছে দেশের চলমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। বলা হয়েছে, এমনিতেই বিনিয়োগকারীরা ভরসা পাচ্ছে না, এর ওপর বিদেশী হত্যায় আরো সংশয় বেড়েছে। যথার্থই আলোচনায় উঠে এসছে তৈরি পোশাক শিল্পের কথা। বলা হয়েছে সবচেয়ে বেকায়দায় রয়েছেন তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। বিদেশী হত্যায় অনেক বিদেশী ক্রেতাই দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। অনেকেই অর্ডার বাতিল করেছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সাথে যুক্ত প্রধানত জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ইতালী। সাম্প্রতিক হত্যাকা-গুলোতে এসব দেশের নাগরিকরাই সবচেয়ে বেশি অক্রান্ত হয়েছেন। গুলশান ঘটনার পরপরই বলা হয়েছে, বিদেশীরা তাদের অর্ডার নিয়ে পুনঃমূল্যায়ন করছে। অর্থাৎ নিরাপদ দেশে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন। একথাই সমর্থন করে নিরাপত্তার ঝুঁকিতে ক্রেতাদের বাংলাদেশে বৈঠক বাতিল করা। যেকেউ স্বীকার করবেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে আছে প্রধানত রেমিটেন্স এবং পোশাক খাতের আয়ের উপর। পোশাক খাতের আয় কেবল বৈদেশিক মুদ্রার জন্যই নয়, দেশের কর্মবিনিয়োগেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সেদিক থেকে বলা যায়, এই খাতের ধস অভ্যন্তরীণভাবে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কার্যত দেশ এখন আমদানী নির্ভর। সে বিবেচনায় যদি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাতে ব্যাপক ধস নামে তাহলে তা যে দেশের অর্থনীতিকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলবে তা বোধহয় লিখে বা বলে বুঝাবার কোন প্রয়োজন হয়না। যত বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কথাই বলা হোক না কেন, জাতীয় অর্থনীতি সক্ষমতা হারিয়ে ফেললে সকলই গরলভেল।
সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি বেঁচে থাকার জন্য যে আস্থার প্রয়োজন তা কার্যত এখন শূন্যের কোঠায় নেমেছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির পাশাপাশি রাজনৈতিক আস্থার পরিবেশ না থাকাই প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখে সংশ্লিষ্টরা যত কথাই বলুক না কেন পরিস্থিতি যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে সেকথা সাম্প্রতিক হামলার ঘটনাবলী এবং পরবর্তী নানা পরিস্থিতির বিশ্লেষণে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আস্থার সংকট কতটা প্রবল হয়েছে তা বোঝা যায় অন্য এক প্রতিবেদনে। বলা হচ্ছে, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত মার্কিনীদের স্বেচ্ছায় ঢাকা ত্যাগ করার অনুমতি দিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে চলাচলের ক্ষেত্রে নিজ দেশের নাগরিকদের সতর্কতা অবলম্বনের আহবান জানিয়েছে। সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার পর নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে দুটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন। বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ তাদের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশের পরিবর্তে এখন বৈঠকটি যুক্তরাষ্ট্রে হবে। অন্যদিকে এশিয়া প্যাসিফিক নেটওয়ার্ক ইনফরমেশন সেন্টার আয়োজিত টেলিকমিউনিকেশন্স বিষয়ক সম্মেলনটির ভেন্যুও পরিবর্তিত হয়েছে। এখন ঢাকার পরিবর্তে শ্রীলঙ্কা বা থাইল্যান্ডে হতে পারে। নিরাপত্তার অভিযোগ তুলে ইতোমধ্যেই পাশ্চাত্যের অনেক দেশ বাংলাদেশে তাদের কার্গোফ্লাইট বাতিল করেছে। সামগ্রিকভাবে এখন অর্থনীতির ভাবনাকে অধিকতর গুরুত্বের সাথে নেয়ার সময় এসে গেছে। কেবলমাত্র কথার ফুলঝুরি বা তোশামোদ নয়, এটা ভেবে দেখার সময় এসেছে কেন এবং কী কারণে প্রকৃতই দেশের অর্থনীতি এই মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে। অর্থমন্ত্রী যাই বলুন না কেন হামলার ঘটনা যে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে এবং ফেলবে সে কথা না বললেও চলে। সামগ্রিকভাবে আস্থার সংকট দূর করা সম্ভব না হলে মূল পরিস্থিতির উন্নয়নের আশা দূরাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। সংকট নিরসনে সকলে কার্যকর ও আন্তরিক উদ্যোগ নেবেনÑ এটাই প্রত্যাশিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন