শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

৩৪৭ কারখানায় ১ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল

পোশাক খাতে করোনার প্রভাব

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ২৩ মার্চ, ২০২০, ১২:০০ এএম

করোনার প্রভাবে প্রথমে কাঁচামাল সরবরাহ সংকটে পড়তে হয়েছিল পোশাক খাতকে। চীননির্ভর কাঁচামালগুলো আসতে পারছিল না। কারণ করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ধীরগতিতে হলেও কাঁচামাল সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও এখন চাহিদা সংকটে পড়েছে দেশের পোশাক খাত। পশ্চিমা দেশগুলোর ক্রেতারা একের পর এক অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায় ভোক্তা চাহিদা কমে বিক্রি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতাদেশ দিচ্ছে ক্রেতারা। এ পর্যন্ত ৩৪৭ তৈরি পোশাক কারখানায় প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বা ১০০ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ পরিস্থিতিতে গার্মেন্টস শিল্প-কলকারখানা আপাতত চালু রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। গতকাল রোববার বিকেলে এক বৈঠক শেষে শ্রম প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

খাতসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিত করা ক্রেতাদের মধ্যে প্রাইমার্কের মতো বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানও আছে। ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত না করতে ৪১ ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ জানিয়ে ই-মেইল দিয়েছে বিজিএমইএ। শিল্পমালিকরা বলছেন, বর্তমানে যে কাজ আছে তা নিয়ে সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ কারখানা সচল রাখা যাবে। এছাড়া একই ছাদের নিচে অনেক শ্রমিক কাজ করায় রয়েছে সংক্রমণের ঝুঁকিও। এ পরিস্থিতিতে কারখানা চালু থাকবে নাকি বন্ধ করে দেয়া হবে, তা নিয়েও আলোচনা চলছে।

এ রকম মহাসংকটের মুখে গার্মেন্ট বন্ধ ঘোষণা করা হবে কিনা সে বিষয়ে বিজিএমইএ এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। গভীর এই সংকটে নানা রকম ক্ষতির বিষয় মাথায় নিয়ে গার্মেন্ট চালু রাখার প্রশ্নে অনেক উদ্যোক্তাই সংক্ষুব্ধ। কেননা রফতানি অর্ডারের সঙ্গে উৎপাদনের সম্পর্ক এবং উৎপাদনের সঙ্গে শ্রমিক কর্মচারীর কাজের মজুরি প্রদানের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই বেশির ভাগ গার্মেন্ট মালিক তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) নেতৃবৃন্দের কাছে এ বিষয়ে দ্রুত সমাধান চান। কিন্তু রোববারও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। শীর্ষ স্থানীয় গার্মেন্ট মালিকদের কয়েকজন বলেন, এমনিতে প্রায় সময় মজুরি ইস্যুতে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে অবরোধসহ সহিংস বিক্ষোভে জড়িয়ে পড়েন। উপরন্তু, সা¤প্রতিক সময়ে নানা কারণে দেশের শিল্প মালিকরা ভালো অবস্থানে নেই। এখন আবার ভয়াবহ করোনাভাইরাসের প্রভাবে সারা বিশ্ব ‘লক ডাউন’ অবস্থার দিকে যাচ্ছে। ফলে সৃষ্ট আর্থিক সংকটের কারণে গার্মেন্ট মালিকদের অনেকে সময়মতো মজুরি পরিশোধ করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এ অবস্থায় অনাকাঙ্খিত কোনো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই এ বিষয়ে বিজিএমইএ-কে সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে আসতে হবে। তারা বলেন, যথাসময়ে বিজিএমইএ সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হলে যে কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতির দায় তাদের ঘাড়েই বর্তাবে।

বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, শ্রমঘন পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের সুরক্ষা ও এ বিষয়ে তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে বিজিএমইএ। এর মধ্যে পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে সার্কুলার দিয়ে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে করণীয় শীর্ষক নির্দেশিকাটি কারখানা কর্তৃপক্ষের নিজস্ব উদ্যোগে প্রিন্ট করে কারখানার গেট, নোটিস বোর্ড, সিঁড়িসহ বিভিন্ন স্থানে লাগানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিজিএমইএর নিজস্ব উদ্যোগে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না, সে বিষয়েও একটি নির্দেশিকা তৈরি করে কারখানাগুলোতে প্রেরণ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে গত ২৪ ঘণ্টায় ১০ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ক্রয়াদেশ হারিয়েছে। এ পর্যন্ত ৩৪৭ কারখানায় প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বা ১০০ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছে। তিনি বলেন, শ্রমিকদের মধ্যে সংক্রমণ ঠেকাতে শ্রম অধিদপ্তরের নির্দেশনার আলোকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এজন্য গার্মেন্টস শিল্প অধ্যুষিত এলাকায় করোনা পরিস্থিতি নজরদারি ও প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিজিএমইএ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে আশুলিয়া, গাজীপুর, ডিএমপি এলাকা ও নারায়ণগঞ্জের মতো জায়গাকে ৪টি এলাকাভিত্তিক (জোনওয়াইজ) কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া করোনা বিষয়ে যেকোনো তথ্য জানানো বা জানার জন্য বিজিএমইএ উত্তরা অফিসে একটি হটলাইন চালু করা হয়েছে। তিনি বলেন, আপাতত কারখানা বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে শ্রমিকরা যেন করোনায় আক্রান্ত না হয়, তার জন্য সব ধনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

সংগঠনটির আরেক সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, খাতটি চরম সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। একদিকে ব্রেক্সিট ইস্যু, ডলারের দাম সমন্বয় না করা, বিশ্ববাজারে চাহিদা কমায় পণ্যের দাম কমে যাওয়া, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ ইত্যাদি কারণে রীতিমতো সারভাইভ করতে কষ্ট হচ্ছে। সেখানে যোগ হয়েছে করোনাভাইরাস ইস্যু। এরমধ্যে একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বড় অঙ্কের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন এ উদ্যোক্তা। রপ্তানিকারক শিল্প মালিকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে দেশের পুরো রপ্তানি খাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছি। তিনি বলেন, পোশাকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ধরনের পণ্য আমদানি স্বাভাবিকের পর যখন উৎপাদন শুরু হলো তখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ক্রয়াদেশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে পোশাক কারখানা রয়েছে চার হাজার ৬২১টি। বর্তমানে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে ৪০ লাখের মতো শ্রমিক কাজ করেন, যার অধিকাংশই নারী। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এর আগেই জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের কারণে বায়াররা অর্ডার বাতিল করছেন। তারপরও কারখানা চালু রাখা হয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) তৈরি পোশাক খাতের রফতানি আয় কমেছে। অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি শেষে পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ২ হাজার ১৮৪ কোটি ৭৪ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ কম। একই সময়ে রফতানি প্রবৃদ্ধিও কমেছে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডায় ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ফ্রান্স ও ইতালিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। দেশগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য সব দোকানপাট ও প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। গ্যাপ, নাইকি, ইন্ডিটেক্সের মতো বিশ্বখ্যাত ব্রান্ডগুলো ঘোষণা দিয়ে বিভিন্ন দেশে তাদের বিক্রয় কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। স¤প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এক প্রতিবেদনে বলেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার বা ২৫ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এটি বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শূন্য দশমিক ১ শতাংশের সমান। বিশ্বব্যাপী দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে আসায় বাণিজ্য, সরবরাহ ব্যবস্থা, ভ্রমণ, পর্যটন, শিল্প উৎপাদনে বাধা তৈরির প্রেক্ষাপটে সম্ভাব্য ক্ষতির ধারণাগত এই হিসাব দিয়েছে এডিবি।

আপাতত বন্ধ হবে না শিল্প-কলকারখানা : শিল্প-কলকারখানা আপাতত চালু রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। তবে পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। গতকাল রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় শ্রম ভবনের সম্মেলন কক্ষে ‘শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক’ শেষে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান এ কথা বলেন। মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, শিল্প-কলকারখানা বন্ধ করা বড় কোনো ঘটনা না। আমরা আপাতত বন্ধ করবো না। তবে সার্বিক বিষয়ে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। তিনি বলেন, সবাইকে সচেতন হতে হবে। সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে করোনা ভাইরাসকে মোকাবিলা করবো। সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন শ্রমসচিব কে এম আলী আজম, শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালক এ কে এম মিজানুর রহমান, জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি ফজলুল হক মন্টু, লেবার ফেডারেশনের সভাপতি শাহ মো. আবু জাফর, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শামীম আরা প্রমুখ। বর্তমানে শ্রম শ্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনসহ গার্মেন্টস শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

৪১ ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ জানিয়ে ই-মেইল দিয়েছে বিজিএমইএ : বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতিতে গার্মেন্টস রপ্তানিতে ধস নামার প্রেক্ষাপটে বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৪১টি ব্র্যান্ডের ক্রেতাগোষ্ঠীর কাছে একটি জরুরি ই-মেইল পাঠিয়েছেন। রুবানা হক বাংলাদেশের ৪১ লাখ শ্রমিকের বেতন-ভাতা, বিশেষ করে আসন্ন দুটি ঈদের কথা বিবেচনায় নিয়ে আগামী জুলাই পর্যন্ত কোনো ক্রয়াদেশ বাতিল বা প্রত্যাহার না করার জন্য বায়িং অফিস গ্রুপের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন