গতকাল বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগে সিঙ্গাপুরের আদালত সে দেশের আইনে এই প্রথমবার দোষী সাব্যস্ত করে চার বাংলাদেশীকে দুই থেকে পাঁচ বছর কারাদ- দিয়েছে। সিঙ্গাপুরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইনে এ বছরের এপ্রিলে আট বাংলাদেশীকে আটক করা হয়েছিল। আলোচ্য চারজন তদের অন্তর্ভুক্ত। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ৩১ মে এই চারজন আদালতে তাদের দোষ স্বীকার করে। এই চার বাংলাদেশীর সবাই শ্রমিক হিসেবে সেখানে কাজ করতে গিয়েছিল। এদের মধ্যে একজন মাঝারিমানের দক্ষ কর্মী। অন্যরা সবাই আধা দক্ষ শ্রমিক হিসেবে সেখানে কাজ করতে গিয়েছিল। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম গত ৩ মে সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানিয়েছিলেন, গত ২৯ এপ্রিল পাঁচজন বাংলাদেশীকে জঙ্গি কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে দেশে ফেরত পাঠায়। এর আগে গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে ২৭ জনকে সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত পাঠানো হয়। এই ২৭ জনের মধ্যে ১৪ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার একটি দৈনিককে জানিয়েছেন, এরা নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের মতাদর্শের অনুসারী। এদের মদদদাতা কারা তা খোঁজা হচ্ছে।
প্রকাশিত বিবরণ ও তথ্যাদি বলছে, সিঙ্গাপুরের আদালতে অভিযুক্ত সবাই মূলত সাধারণ শ্রমিক। নিতান্ত রুটি-রুজির তাগিদেই তারা বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল। এখন তাদের সেখানে কারাবন্দী জীবনযাপন করতে হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে তা নিয়ে ইতোমধ্যেই নানা আলোচনা হয়েছে। বলা হচ্ছে, তাদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতেই বিচার করা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশীরা কতটা অসহায় বিশেষ করে এধরনের ইস্যুতে তা সহজেই অনুমেয়। একথা অস্বীকারের কোন উপায় নেই যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ইরাক আগ্রাসনের পর থেকে কথিত জঙ্গি ইস্যু এক ধরনের স্পর্শকাতরতায় রূপ নিয়েছে। এটা এক ধরনের ফাঁদও বটে। বিশেষ করে সাধারণ লোকদের আটকাতে এ ফাঁদ যুতসই হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের মোবারকের কথা অনেকেরই মনে আছে। তাকে কথিত ভয়ংকর সন্ত্রাসী হিসেবে মার্কিন বাহিনী আটক করেছিল অথচ ছেড়েছে নির্দোষ হিসেবে। নির্যাতন আর নিপীড়নে কেটে গেছে তার জীবনের কয়েকটি বছর। এধরনের গুরুতর অভিযোগে আটক গুয়ান্তানামো বে কারাগার থেকে অনেককেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে কোন ধরনের অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায়। বাংলাদেশে গত কিছুদিনে ভিন্ন বাস্তবতা দেখা দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, কেউ আড্ডায় মিলিত হলে এমনকি কেউ কারো বাড়িতে বেড়াতে এলেও একে সন্ত্রাসীদের গোপন বৈঠক হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। সিঙ্গাপুরের আলোচ্য ঘটনাতেও দেখা যাচ্ছে, অভিযুক্তরা নিয়মিত দুটি পার্কে সমবেত হতো। সেই সাথে বাংলাদেশে অভিযান পরিকল্পনার কথাও বলা হয়েছে। এধরনের শ্রমিকদের পার্কে সমবেত হওয়াকে উপাত্ত হিসেবে নেয়া কতটা যৌক্তিক সেটিও বিবেচ্য বিষয়। দেশে অভিযান পরিচালনার কথা বলার ফলে তাদের দেশে ফিরে আসা অনিশ্চিত হয়ে উঠেছিল। একটু ভিন্নভাবে দেখলে এটা দেশের শ্রমশক্তি বিরোধী এক ধরনের চক্রান্তও হতে পারে। বর্তমানে সিঙ্গাপুরে বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের প্রয়োজন রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিদ্যমান বাস্তবতায় বাংলাদেশীদের সেখানে কাজ করার অনুমতি পেতে বেগ পেতে হবে। সেখানে ব্যাপক সংখ্যায় ভারতীয়রা রয়েছে। শুধু সিঙ্গাপুরেই নয়, যেখানেই ভারতীয়রা রয়েছে সেখানেই বাংলাদেশী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। সে বিবেচনায় বিষয়টি খতিয়ে দেখার সুযোগ রয়েছে। একথাও নতুন করে উল্লেখের প্রয়োজন নেই, ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস রেমিটেন্সে টান পড়তে শুরু করেছে। চলমান প্রক্রিয়া বা প্রবণতা যে সেই টানে আরো ইন্ধন যোগাবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
সিঙ্গাপুরে চার যুবকের বিরুদ্ধে যত বড় ধরনের অভিযোগ তোলা হয়েছে এত বড় ঝুঁকি গ্রহণের সামর্থ্য প্রকৃতই তাদের রয়েছে কিনা সে বিষয়টি বিশ্লেষণের দাবী রাখে। এটা প্রকৃতই কোন পাতানো ফাঁদছিল কিনা সে ব্যাপারে অবশ্যই খোঁজ-খবর নেয়া দরকার। আমাদের সেখানকার দূতাবাস কী ধরনের ভূমিকা নিয়েছে তা স্পষ্ট নয়। সেখানে যাই ঘটুক, এখন বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জাতীয় স্বার্থ নিয়ে। দেশে দেশে বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগ যাতে অপপ্রচার বা অপপ্রচারণার শিকার না হয় বা হতে না পারে সেজন্য আমাদের সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ জরুরী। একথা সঙ্গতভাবেই বুঝতে হবে, যাই কিছু হোক বা ঘটুক তার খেসারত আমাদেরই দিতে হবে। সে কারণে কোথায় কি করে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত করা যায় সেদিকে সংশ্লিষ্টদের নজর দেয়া জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে। আলোচ্য ঘটনা যেহেতু দেশের মানুষ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেয় তাই যাতে ইতিবাচক ধারণার জন্ম হতে পারে সেজন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সকলে এ ব্যাপারে আন্তরিক হবেন, এটাই প্রত্যাশিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন