দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই’র সাম্প্রতিক দুই দিনের বাংলাদেশ সফর ছিল সামগ্রিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঈদের আগে ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসী হামলায় দেশী-বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনা এবং ঈদুল ফিতরের দিন দেশের বৃহত্তম ঈদের জামাত কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ময়দানের পাশে পুলিশের চেকপোস্টে হামলায় কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবল ও এক গৃহিণী নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশের জঙ্গিবাদী তৎপরতার ঘটনাগুলো এখন সত্যিকার অর্থেই একটি বৈশ্বিক ফোকাসে চলে এসেছে। গত কয়েক বছর ধরে সংঘটিত নাশকতা, গুপ্তহত্যা ও টার্গেটেড কিলিং-এর ঘটনাগুলোকে সরকার এতদিন আভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে দাবী করলেও এখন এসব ঘটনার সাথে বৈশ্বিক সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। হলি আর্টিজান রেস্টেুরেন্টে সন্ত্রাসী হামলার পর সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সমস্যা মোকাবেলায় প্রতিবেশী ও আন্তর্জাতিক সহযোগীদের সহায়তা আহ্বান করা হয়। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী নিশা দেশাই তার বাংলাদেশ সফর শেষে ঢাকা ত্যাগ করার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় সরকারের এই নীতিগতভাবে পরিবর্তিত অবস্থানকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন। একই সঙ্গে তিনি সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার প্রস্তাবে বাংলাদেশ দ্রুত সাড়া দিলে যৌথভাবে তারা সন্ত্রাসীদের পরাস্ত করতে সক্ষম হবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। প্রত্যেক দেশের আভ্যন্তরীণ জাতিগত বিরোধ, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকে কাজে লাগিয়ে আইএস, আল-কায়েদাসহ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো তাদের তৎপরতার বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে। এসব রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, সামাজিক সমস্যার পাশাপাশি তথাকথিত সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের ভুল নীতি কতটা দায়ী সে বিষয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। রাজধানীর সবচেয়ে সুরক্ষিত এলাকায় একের পর এক বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনাসহ ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবেলা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ, রফতানী বাণিজ্য তথা জাতীয় অর্থনীতিতেও ইতিমধ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে বিশেষ সতর্কতা জারিসহ দেশের বিমান বন্দরে কার্গো বিমান উড্ডয়নে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় বৈদেশিক বাণিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক ধরনের আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরী হচ্ছে। এহেন বাস্তবতার মধ্যেই পর পর দু’টি ‘হাই প্রোফাইল’ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোকে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হুমকি মোকাবেলায় অনেক বেশী সক্রিয় ও তৎপর দেখা যাচ্ছে।
ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানগত কারণে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গুরুত্ব এবং বিশ্বের অন্যতম মুসলমান জনসংখ্যাবহুল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্র হতে পারে। এ কারণেই বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী ঘটনাবলীর সাথে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের যোগসূত্র থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে এদেশে কোন ধর্মীয় ও জাতিগত সংকট না থাকা এবং এদেশের মানুষের উদারনৈতিক মনোভাব এবং পরমত-পরধর্ম সহিষ্ণুতার কারণে হাজার বছর ধরে এখানে সকল ধর্ম ও শ্রেণী-বর্ণের মানুষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ অটুট রয়েছে। এক সময় দেশের কোন কোন অঞ্চলে চরম বামপন্থী দল হত্যা ও নাশকতা চালালেও এদেশের জনসমাজে তাদের কোন ঠাঁই না থাকায় তারা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। একইভাবে এ দেশের মানুষ কোন ভ্রান্ত ধর্মীয় চরমপন্থাকেও কখনো সমর্থন করেনি, ভবিষ্যতেও করবেনা। বাংলাদেশে কথিত সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদের সমস্যা যেমন মধ্যপ্রাচ্য বা পশ্চিমা দেশগুলোর মত নয়, ঠিক এ কারণেই এই সমস্যা মোকাবেলায় প্রয়োজনে বিদেশীদের অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা গ্রহণ করা হলেও সমস্যার মূলোৎপাটন ও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নিজেদেরই করতে হবে। এ কথা অস্বীকার করা যাবেনা যে, দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সেই সাথে প্রায় প্রতিটি সন্ত্রাস-নাশকতার ঘটনায় সরকার ও বিরোধীদলকে ব্লেইম গেমে জড়িত হয়ে পড়তে দেখা গেছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের কুশীলবরা বাংলাদেশে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে থাকতে পারে। এটা পরিষ্কার যে, সন্ত্রাসী ঘটনার ক্রীড়নক হিসেবে আমাদের শিক্ষিত তরুণদেরই ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত ও সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার বোধ সক্রিয় থাকলে তরুণদের বিভ্রান্ত বা প্রলুব্ধ করা সহজ হয়। বাংলাদেশে শহুরে সচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবারের তরুণদের সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার পেছনে ঠিক কি কি বিষয় কাজ করছে তা’ বিশেষভাবে খতিয়ে দেখা জরুরী। বিদ্যমান বাস্তবতায় দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের স্বপ্ন বাস্তবায়নের তাগিদেই গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক সমঝোতা জরুরী। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদসহ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক সমঝোতা, ঐক্য ও জাতীয় সংহতি গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন