মাঝে একদিন বেড়ে ইতালিতে মৃতের সংখ্যা আবারও কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৬৮৩ জন মারা গেছেন। আর নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ২১০ জন। করোনায় ইতালির মৃতের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এদিনে ৬৮৩ জন নিয়ে দেশটিতে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৫০৩ জনে। আর আক্রান্তের সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৩৮৩ জনে। তবে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন অনেকেই। ৯ হাজার ৩৬২ জন এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। মৃত্যুর মিছিল বেড়েছে স্পেনেও। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৪৪৩ জন। এ নিয়ে সেখানে মোট মৃতের সংখ্যা দঁাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৩৪ জন। এর আগেই তারা করোনায় মৃতের সংখ্যায় চীনকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
এদিকে বিশ্বজুড়ে মৃতের সংখ্যা সাড়ে ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। গতরাতে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ২০ হাজার ৫১৯ জনের মৃত্যু ঘটেছে। আক্রান্ত বেড়ে হয়েছে ৪ লাখ ৫৩ হাজার ০৭৪ এবং সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১ লাখ ১৩ হাজার ১২১ জন।
গত রোববার ও সোমবার মৃতের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে আসায় পর্যবেক্ষক মহলে উৎসাহ দেখা দিলেও মঙ্গলবার সিভিল প্রটেকশন এজেন্সি জানায়, ইতালিতে করোনভাইরাসে প্রাণহানি ফের বেড়ে গেছে। ২১ ফেব্রুয়ারি উত্তরাঞ্চলে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা গণনা করা হয় গত মঙ্গলবার ৭৪৩ এবং সোমবার ছিল ৬০২ জন। ইতালিতে অন্য সব দেশের চেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মাত্র এক মাসে এই সংক্রমণে ৬ হাজার ৮২০ জন মারা গেছে।
মঙ্গলবার নিশ্চিত হওয়া মোট রোগীর সংখ্যা ৬৯ হাজার ১৭৬ জন। তবে ইতালি কেবল গুরুতর লক্ষণযুক্ত লোকদের পরীক্ষা করেছে। নাগরিক সুরক্ষা সংস্থার প্রধান বলেছেন যে, সংক্রমিত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা সম্ভবত ১০ গুণ বেশি।
অ্যাঞ্জেলো বোরেলি লা রিপাবলিকা সংবাদপত্রকে বলেন, ‘প্রতি দশজনের মধ্যে একটি ঘটনার নথিভুক্তিকরণ বিশ্বাসযোগ্য অনুপাত’। তিনি বিশ্বাস করেন যে, প্রায় ৭ লাখ লোক সংক্রমিত হয়ে থাকতে পারে।
সর্বশেষ তথ্যটি এমন একটি দেশের জন্য হতাশাজনক যেটি দুই সপ্তাহ ধরে লকডাউনে রয়েছে। স্কুল, বার এবং রেস্তোরাঁ বন্ধ এবং ইতালীয়দের অনিবার্য প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বেরুনো নিষেধ।
সোমবার সরকার দেশের প্রয়োজনীয় সরবরাহ চেইনের জন্য অপরিহার্য বলে মনে না করা সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেয় এবং সর্বশেষ পরিসংখ্যানের পরে প্রধানমন্ত্রী জিউসেপ্প কন্টি লোকদের বাড়ির বাইরে যাওয়া লোকদের পূর্বের জরিমানা ২০৬ ইউরো থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার ইউরো (৩,২২২ ডলার) ধার্য করেছেন।
সংক্রমণ এড়ানোর জন্য প্রত্যন্ত ভিডিও লিঙ্কে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেককে অবশ্যই ভ‚মিকা নিতে হবে’। ‘যদি প্রত্যেকে নিয়ম মানেন তবে তারা কেবল নিজের এবং তাদের প্রিয়জনদের সুরক্ষা করবেন না, তবে তারা পুরো জাতিকে এই জরুরি অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম করবেন’।
অর্থনৈতিক ক্ষতি
দেশটিতে মৃত্যুর সংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত বলবৎ লকডাউনের মেয়াদ বাড়াতে হতে পারে বলে জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। গত মঙ্গলবার জারি করা একটি ডিক্রি সরকারকে এই সময়সীমা ৩১ জুলাই পর্যন্ত বাড়ানোর ক্ষমতা দিয়েছে। তবে কন্টি সেই তারিখ পর্যন্ত লকডাউন বর্ধিত করার পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে বলেন যে, তিনি ‘ততক্ষণে ভাল প্রতিরোধ গড়ে তোলায় আশাবাদী।
মঙ্গলবার বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস পূর্বাভাস দিয়েছে যে, প্রাদুর্ভাবের আগেই মন্দায় থাকা ইটালির অর্থনীতি এ বছর ১১ শতাংশের বেশি সঙ্কুচিত হবে। অর্থমন্ত্রী রবার্তো গুয়ালটিয়ী সংসদে বলেছেন যে, তিনি ‘কয়েক শতাংশ পয়েন্ট’ সঙ্কোচনের আশা করেন।
সিভিল প্রটেকশন এজেন্সি বলেছে যে, স্বাস্থ্যসেবার মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে বড় সমস্যা হ’ল মুখোশ ও ভেন্টিলেটরগুলির অভাব -করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে হাসপাতালগুলিতে এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। সমস্যাটি বুঝতে পেরে ভেনেটোর আঞ্চলিক গভর্নর লুকা জাইয়া ভেটেরিনারি সার্জারিতে ব্যবহৃত ভেটেরিনেটরগুলি বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দিয়ে বলেছিলেন যে, সেগুলো মানুষের ব্যবহারে রূপান্তরিত হতে পারে।
অন্যান্য দেশগুলি যখন তাদের নিজস্ব চিকিৎসা সরবরাহ করতে চাইছে, তখন ইতালীয় টেক্সটাইল এবং ফ্যাশন সংস্থাগুলির একটি কনসোর্টিয়াম তাদের উৎপাদন লাইনে রূপান্তর এনে প্রয়োজনীয় পরিমাণ মাস্ক উৎপাদনে যাচ্ছে।
জরুরি অবস্থার জাতীয় কমিশনার ডোমেনিকো আরকুরি সাংবাদিকদের বলেছেন ‘(এটি) আমাদের সিস্টেমকে এ রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং আমদানি নির্ভরতা এড়াতে আমাদের প্রয়োজনীয় রসদ যোগাবে’।
চীনে দ্বিতীয় দফা করোনা প্রাদুর্ভাবের শঙ্কা
চীনের রাষ্ট্রীয় পত্রিকাটি সতর্ক করে দিয়েছে যে, মহামারী বাড়ার সাথে সাথে চীনে দ্বিতীয় দফা করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের ‘সম্ভাবনা প্রবল’ এবং ‘অনিবার্য’ও। রাষ্ট্র পরিচালিত গেøাবাল টাইমসের মতে, স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রক্রিয়ার ফাঁকফোকর এবং বিদেশ থেকে আগত লোকদের জন্য পর্যাপ্ত কোয়ারানটাইন ব্যবস্থা না থাকাই নতুন সঙ্কটের মূল কারণ। পূর্বের কেন্দ্রস্থল হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান ছাড়া অন্যসব এলাকা দুই মাসের জন্য আবদ্ধ থাকার পরে গত মঙ্গলবার রাতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেয়ার সময় এ সতর্ক করা হয়েছে। একই সঙ্গে পাঁচ দিনের শূন্য সংক্রমণের পরে উহানে এদিন প্রথম একজন চিকিৎসক স্থানীয়ভাবে আক্রান্তের তথ্য নথিভুক্ত হয়েছে।
‘চীনের অনেক আগেই করোনা ছড়িয়েছিল ইতালিতে!’
ইতালির এক চিকিৎসকের দাবি, চীনের অনেক আগেই ইতালিতে ছড়িয়ে পড়েছিল এই মারণ ভাইরাস। আর তিনি এই দাবির পিছনে বেশ কিছু যুক্তিও দাঁড় করিয়েছেন। মিলানের মারিও নেগরি ইনস্টিটিউট ফর ফার্মাকোলজিক্যাল রিসার্চ-এর প্রিন্সিপাল জুসেপ্পে রেমুজ্জি জানিয়েছেন, ইতালিতে অনেক আগেই করোনা ছড়াতে শুরু করেছিল। চীনের উহানের আগে ইতালির লুম্বার্ডিতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল করোনা। আর সেটা চীনের উহানে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগের ঘটনা। সে সময় এই মহামারির বিষয়ে তিনি ও একদল চিকিৎসক ইতালির প্রশাসনকে সতর্ক করেছিলেন বলেও দাবি করেন জুসেপ্পে। গত নভেম্বরে ইতালির দক্ষিণাঞ্চলে অপরিচিত এক ধরনের নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এই নিয়ে প্রশাসনকে জানানো হলেও উদাসীন মনোভাব দেখায় সরকার।
করোনার কারণে হজ বাতিল করা হবে না
এদিকে করোনাভাইরাসের কারণে সউদী সরকার এ বছরের হজ বাতিল ঘোষণা করেছে বলে যে গুজব ছড়িয়েছে তা সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন পাকিস্তানে নিযুক্ত সউদী আরবের রাষ্ট্রদূত নওয়াফ বিন সাআদ আল-মালিকি। উর্দু নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, হজ বাতিল করার সিদ্ধান্ত যদি নেয়া হয়, তাহলে সময় মতো হজযাত্রীদের করণীয় কী হবে, সে সম্পর্কেও আগাম জানিয়ে দেয়া হবে। এখন পর্যন্ত এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। গত ২ ফেব্রæয়ারি সউদী সরকার করোনাভাইরাসের কারণে ওমরাহ ও পর্যটন সাময়িকভাবে স্থগিত করেছিল। এরপর ৪ মার্চ একই কারণে ওমরার জন্য অর্থ গ্রহণও সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়।
আমির খানের সহায়তার প্রস্তাব
প্রাক্তন লাইটওয়েল্টারওয়েট বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আমির খান করোনভাইরাস প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করার জন্য এনএইচএসকে বোল্টনে তার ৫ মিলিয়ন পাউন্ডে ভেন্যু ব্যবহারের প্রস্তাব করেছেন। এটি আগস্টে একটি বিয়ের ভেন্যু হিসাবে খোলার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল। তবে জনগণের সুরক্ষার পক্ষে এই পর্যায়ে অগ্রাধিকার প্রয়োজন বলে খান এখন চাবি হস্তান্তর করতে প্রস্তুত। ৩৩ বছর বয়সী এ বক্সার টুইটারে লিখেছেন: ‘এই দুঃখজনক সময়ে হাসপাতালের বিছানা পাওয়া জনসাধারণের পক্ষে কতটা কঠিন সে ব্যাপারে আমি সচেতন। আমি আমার ৬০ হাজার বর্গফুটের ৪ তলা বিল্ডিং এনএইচএসকে দিতে প্রস্তুত যা করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্থ লোকদের সহায়তা করার জন্য একটি স্থাপনা হতে পারে। দয়া করে নিরাপদ থাকুন’। আমির খান হলেন সর্বশেষ ব্যক্তি যিনি করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। সূত্র : রয়টার্স, স্ট্যান্ডার্ড, এএফপি, ডেইলি মেইল, লা রিপাবলিকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন