ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রণীত ও নির্দেশিত জুমার খুতবা গতকাল দেশের ৩০ লাখ মসজিদে পঠিত হয়েছে। তার আগে প্রণীত এই খুতবা মসজিদগুলোতে পাঠানো হয়। হাজার বছর ধরে চলে আসা জুমার খুতবার পরিবর্তে প্রথমবারের মতো ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রণীত খুতবা পঠিত হয়েছে। এই খুতবা পঠন বাস্তবায়নের আগে থেকেই দেশের আলেম-ওলামার মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তারা এর প্রতিবাদও করেন। তাদের এই প্রতিবাদ উপেক্ষা করেই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি নতুন খুতবা পড়ার তাগিদ ও নির্দেশনা দেন। এর ফলে ইসলামী চিন্তাবিদ এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বেশির ভাগ ইসলামী চিন্তাবিদ মনে করেন, এর মাধ্যমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এই ধারণাই প্রতিষ্ঠিত করছে যে, মসজিদের খুতবায় জঙ্গিবাদী কর্মকা-ে উৎসাহ ও উস্কানি দেয়া হয়। যে খুতবা হাজার বছর ধরে চলে আসছে এবং কোনো ধরনের জঙ্গিবাদী ঘটনা কখনো ঘটেনি, গত কয়েক মাসের সংঘটিত জঙ্গি হামলার ঘটনায় তার খোলনলচে বদলে ফেলার এই উদ্যোগে আলেম-ওলামা তো বটেই, সাধারণ মানুষও ক্ষুব্ধ এবং মর্মাহত। ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে দায় চাপাতে চাচ্ছে যে, মসজিদ-মাদরাসাগুলো জঙ্গিবাদের প্রেরণাদাতা। হেফাজতে ইসলামীর আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী যথার্থই বলেছেন, মসজিদে খতিবগণকে নজরদারি এবং নতুন খুতবা পঠনের অর্থ হচ্ছে, সন্ত্রাস ও হত্যাকা-ের দায় ইসলামের ওপর চাপানোর চেষ্টা করা। এর মাধ্যমে বিশ্বে এই বার্তাই যাবে, বাংলাদেশের লাখ লাখ মসজিদের খতিব জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের প্রতি উদ্বুদ্ধকরণ কাজে জড়িত। নিশ্চিতভাবেই দেশের ভাবমর্যাদার জন্য এটি মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের দেশের মুসলমানরা হাজার বছর ধরে চলে আসা খুতবা শুনে আসছে এবং এর প্রতি তাদের অপরিসীম আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। এই খুতবাই তাদের ধর্মীয় শাসন-বারণ, অনুশাসন, অন্যায়-জুলুম থেকে বিরত রাখা এবং মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখে চলেছে। তাদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহমর্মী হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। বিগত কয়েক মাস ধরে সংঘটিত হত্যাকা-, গুলশান ও শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার কারণে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক মসজিদের খতিবদের ওপর নজরদারি এবং নতুন খুতবা প্রণয়ন ও পঠনের উদ্যোগ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, যেন এসব সন্ত্রাসী কর্মকা-ের জন্য খতিব ও প্রচলিত খুতবাই দায়ী। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজির এমন ধারণা কেন হলো, তা দেশের আলেম-ওলামার বোধগম্য নয়। এটা যে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ ও ইসলামের ওপর দায় চাপিয়ে দেয়ার শামিল, এই সরল সত্যটুকু উপলব্ধি করার মতো জ্ঞান তার আছে বলে ইসলামী চিন্তাবিদরা মনে করেন না। বিষয়টিকে বৃহৎ পরিসরে বিবেচনা না করে দু-একটি আধুনিক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া তরুণদের বিপথগামী হওয়ার দায় মসজিদ-মাদরাসার ওপর চাপিয়ে দেয়া এবং নজরদারি করার এই মানসিকতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাযথ ধর্মীয় শিক্ষার অনুপস্থিতিই যে এর অন্যতম প্রধান কারণ, তা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা হয় বুঝতে অক্ষম, না হয় এড়িয়ে যাচ্ছেন। তারা আমাদের দেশে দেশী-বিদেশী যেসব গোষ্ঠী জঙ্গিবাদের উত্থানের তকমা লাগাতে উঠেপড়ে লেগেছে, তাদেরই এজেন্ডা যেন বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন। অথচ এ কথা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মানুষ জানে, মাদরাসাগুলোতে শুধু নামাজ-রোজা ও হজ-জাকাতের শিক্ষা দেয়া হয় না, আল্লাহভীতি ও পরকালীন কঠোর শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পেতে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন, দেশপ্রেম, আদর্শ এবং নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া হয়। ফলে শত শত বছর ধরে এক-দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনায় মাদরাসায় খুন-খারাবি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। মসজিদের খুতবায় প্রভাবিত হয়ে দাঙ্গা-ফ্যাসাদের ঘটনার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ইসলামী চিন্তাবিদরা প্রশ্ন তুলেছেন, মসজিদ-মাদরাসায় নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই কি ইসলামিক ফাউন্ডেশন সৃষ্টি করা হয়েছে? অযাচিত সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করার এ ধরনের কর্মকা- করার অর্থ কী? ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং এখানে উগ্রতা ও সন্ত্রাসের কোনো ঠাঁই নেই, এ কথা এদেশের মানুষের অজানা নয়। জানা বিষয়ের ওপর নতুন করে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার অর্থই হচ্ছে, মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়া। খুতবা রচনা ও তা পঠনের নির্দেশ দান এবং মসজিদ-মাদরাসায় নজরদারি করার সিদ্ধান্ত মানুষের চিরন্তন বিশ্বাসের মূলে আঘাত করারই শামিল। অথচ জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ কেবল আমাদের দেশীয় কোনো সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা। আমাদের দেশে এই সংকটের মূল রাজনৈতিক। রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তি ও চরম অসহিষ্ণুতা, গণতান্ত্রিক পরিবেশ সংকুচিত হয়ে পড়াই উগ্রবাদকে উস্কে দিচ্ছে। এখানে মসজিদ-মাদরাসার কী ভূমিকা থাকতে পারে? আমরা দেখেছি, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে যখন ভয়ংকর হামলা হয়, তখন তারা বিষয়টিকে সন্ত্রাসীদের কাজ হিসেবেই ধরে নেয়। এর জের ধরে তাদের কখনোই কোনো মসজিদ বা আলেমদের ওপর নজরদারি করতে দেখা যায় না। শুধু পার্শ্ববর্তী দেশ নয়, ইউরোপ-আমেরিকায়ও সন্ত্রাসী হামলার জন্য এ ধরনের নজরদারি দেখা যায় না। তারা বড় জোর ধর্মীয় নেতাদের সাথে বৈঠক করে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় আলাপ-আলোচনা এবং কীভাবে তা প্রতিহত করা যায়, এ পরামর্শ চান। অন্যদিকে আমাদের দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষদের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গায় নজরদারি-খবরদারির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এ ধরনের হঠকারী ও অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্ত সরকারের ভাবমর্যাদাকে ক্ষুণœ করছে, তাকে বেকায়দায় ফেলার পথ সৃষ্টি করছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এসব কর্মকা- ও সিদ্ধান্তের ফলে অনেকের মনে এই ধারণাই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, কে কীভাবে ধর্মপালন করবে এ সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব যেন তাদের। ইসলামের বিধি-বিধানের মধ্যে থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে এতদিন মানুষ যে ধর্মকর্ম করে আসছে, তাতে প্রতিষ্ঠানটি বাগড়া ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। এ ধরনের প্রবণতা এদেশের মুসলমানদের মধ্যে যেমন দ্বিধার জন্ম দিচ্ছে, তেমনি স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনেরও অন্তরায় হয়ে উঠছে। আমরা আশা করি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন এ ধরনের বিতর্কিত কর্মকা- থেকে সরে আসবে। তার বোঝা উচিত, তাকে কেউ ইসলামের সৌল এজেন্ট দিয়ে দেয়নি। অযথা ও অনাকাক্সিক্ষত সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে এদেশের মাদরাসা শিক্ষা ও আলেম-ওলামাদের টার্গেটে পরিণত করা কোনো সুস্থ মানসিকতা হতে পারে না। সরকার বিষয়টি আমলে নিয়ে জন-আকাক্সিক্ষত সিদ্ধান্ত নেবে, এটাই আমরা আশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন