ফ্রান্সে ফের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর নিসে বাস্তিল দুর্গ পতন দিবসের অনুষ্ঠান যখন চলছিল তখন ট্রাক নিয়ে হামলা চালানো হয়। এতে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ৮৪ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ট্রাক চালক নিহত হয়েছে। ট্রাকে বিস্ফোরক, বোমা ও গ্রেনেড পাওয়া গেছে। নিহত ট্রাক চালক তিউনিসিয়ার বংশোদ্ভূত ফরাসী নাগরিক বলে ধারণা করা হচ্ছে। সরকারীভাবে সকলকে ঘরে নিরাপদে অবস্থান করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তিনদিনের শোক দিবসের ঘোষণাসহ জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরো তিনমাস বাড়ানো হয়েছে। চরম বর্বরোচিত ও কাপুরুষোচিত এই বিপুল প্রাণহানিকর সন্ত্রাসী হামলার নিন্দার ভাষা নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। আমরা ফ্রান্সের সরকার, জনগণ ও হতাহতদের পরিবার-পরিজনের প্রতি গভীর সহমর্মিতা জ্ঞাপন করছি। আমরা বিশ্বাস করি, ফ্রান্সের এই বিপর্যয়ে বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ ও মানবম-লী তার পাশে এসে দাঁড়াবে এবং সাহসী ফরাসী জাতি এই দুঃখ, শোক ও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হবে। সন্ত্রাসী হামলা যেন ফ্রান্সের পিছু ছাড়ছে না। একের পর এক হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটছে। গত বছর নভেম্বরে বিশ্বের শিল্প-সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে পরিচিত প্যারিস ভয়ংকর সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়। প্রায় একই সময়ে এই শহরে অন্তত ৬টি জায়গায় সন্ত্রাসীরা বোমা ও বন্দুক নিয়ে হামলা চালায়। এই সিরিজ হামলায় দেড় শতাধিক মানুষ নিহত ও প্রায় দু’শ’ মানুষ আহত হয়। প্যারিসের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বাটাক্লুঁ কনসার্ট হলে সবচেয়ে বড় হামলাটি হয়। কনসার্ট চলার সময় পরিচালিত এ হামলায় শতাধিক মানুষ নিহত হয়। একটি স্টেডিয়ামের বাইরে হামলা হয়। স্টেডিয়ামে তখন ফ্রান্স-জার্মানীর প্রীতি ফুটবল ম্যাচ চলছিল। একই সময়ে যুগপৎ এসব হামলায় প্যারিসে একটা ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। হতাহতদের আর্ত হাহাকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। এর আগে জানুয়ারিতে প্যারিসেই শার্লী এবদো নামের একটি ম্যাগাজিনের অফিসে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ২০ জন নিহত হয়।
সন্ত্রাসী হামলার আশংকা ও ঝুঁকি থেকে বিশ্বের কোনো দেশই যে নিরাপদ নয়, ১লা জুন বাংলাদেশের ঢাকায় ও গত বৃহস্পতিবার ফ্রান্সের নিসে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা তার প্রমাণ বহন করে। এর আগে নরওয়ে, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ইতালি প্রভৃতি ইউরোপীয় দেশে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, লিবিয়া প্রভৃতি দেশে সন্ত্রাসী হামলা তো নিত্যদিনের ঘটনা। সম্প্রতি তুরস্কে ও সউদী আরবেও সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। পরিকল্পিত এসব সন্ত্রাসী হামলায় নিরীহ-নিরপরাধ মানুষই প্রধানত হতাহত হয়েছে। নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব থাকতে পারে না। কাপুরুষরাই কেবল এটা করতে পারে। যারা এটা করছে তাদের কোনো মহৎ লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। একমাত্র বিভ্রান্ত ও বিকারগ্রস্তরাই এ রকম অপকর্ম ও নাশকতা করতে পারে। ইসলামের নামে কিংবা অন্য কোনো মতাদর্শের নামে এ সব হামলা ও হত্যাকা- কেউই সমর্থন করে না, করতে পারে না। ইসলাম কখনোই সন্ত্রাসী হামলা ও নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ হত্যাকে সমর্থন করে না। ইসলামের নামে কেউ বা কোনো গোষ্ঠী যদি এটা করে, তবে তার দায় ওই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর। ইসলামের নয়, তার অনুসারীদেরও নয়। দুঃখজনক হলেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কোথাও কোনো মুসলমান নামধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটলে তার দায় ইসলাম ও মুসলমানদের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্ঠা হচ্ছে এবং মুসলমানদের সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করা হচ্ছে। তাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তাদের বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকারে পরিণত করা হচ্ছে। এতে বহুত্ববাদী দেশ ও সমাজে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে। সামাজিক সংঘাতের পথ প্রশস্ত হচ্ছে। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের পর ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মুসলমানরা হামলার শিকার হয়, তাদের মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়। দেখা গেছে, যেখানেই সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে সেখানেই মুসলমানরা আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে হামলা মুসলমানদের বিদ্বেষ, বৈষম্য, পীড়ন ও ক্ষতির শিকারে পরিণত করে সে হামলা মুসলমানদের স্বার্থে ও কল্যাণে হয়েছে তা মনে করা যায় না। যারা ইসলামের নামে এটা করছে তারা প্রকৃত মুসলমান নয়, মুসলমানদের মিত্রও নয়। দেখা গেছে, প্রতিটি সন্ত্রাসী হামলার পর মুসলমানরাই এর সবচেয়ে বেশী প্রতিবাদ করেছে। এই বিষয়টি অমুসলিম প্রতিটি দেশ ও মানুষকে বিশেষভাবে অনুধাবন করতে হবে।
এটাও লক্ষণীয় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের লোকদের মধ্যে সদ্ভাব হ্রাস পাচ্ছে। হিংসা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি কালো-ধলার মধ্যে যে বিরোধ-সংঘাত-খুনোখুনি হয়েছে তা সামাজিক সংঘাত বা বর্ণ সংঘাত ছাড়া কি বলা যাবে। মার্কিন সমাজের অভ্যন্তরেই এই সংঘাতের উৎস ও কারণ নিহিত রয়েছে। সকলেরই জানা, ফ্রান্স একদা ঔপনিবেশিক শক্তি ছিল। বিভিন্ন দেশ তার উপনিবেশ ছিল। সেই দেশগুলোর মধ্যে মুসলিম দেশও ছিল। ওইসব দেশ থেকে বহু মুসলমান ফ্রান্সে এসেছে, বসতি গড়েছে ও নাগরিকত্ব লাভ করেছে। কিন্তু সমমর্যাদা ও অধিকার তারা এখনো সেভাবে পায়নি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ আছে। তাদের ব্যাপারে ফরাসীদের মনোভাবও খুব ইতিবাচক নয়। এ নিয়ে বৃহত্তর ফরাসী সমাজে এক ধরনের টানাপোড়েন আছে। আরও একটি বিষয় হলো, মতাদর্শ দিয়ে মতাদর্শ মোকাবিলা করা যায়, শক্তি প্রয়োগেও অনেক কিছু করা যায়। কিন্তু ব্যক্তি মনকে কোনো কিছু দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বিদ্বেষপ্রসূত ব্যক্তিমন অনেক অঘটন ঘটাতে পারে। সে ক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায়, সাম্য ও সুবিচার কার্যকর প্রতিষেধক হতে পারে। দমন ও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এর ফয়সালা করা সম্ভব নয়। এই প্রেক্ষাপটে অদ্ভুত চিন্তা ও ভ্রান্ত মতাদর্শের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। প্রমাণিত হয়েছে, লাগাতার সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের পরও সন্ত্রাস বাড়ছে। কাজেই এ পথে সন্ত্রাসমুক্ত বিশ্ব গড়া যাবে না। সন্ত্রাসমুক্ত বিশ্ব গড়তে ভিন্ন পথ সন্ধান করতে হবে। সন্ত্রাসের উৎস উৎসাধনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন