গার্মেন্ট শিল্প-কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের আক্কেল আছে বলে মনে হয় না। কোন বিবেচনায় মালিকরা কারখানা খোলার এবং শ্রমিকরা কাজে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা স্বাভাবিক বোধসম্পন্ন কোনো মানুষের বুঝে আসে না। গত দু’তিন দিন ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকার বাস ও লঞ্চ টার্মিনাল, ফেরিঘাটসহ সড়ক-মহাসড়কে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা গেছে। ঢাকামুখী এসব মানুষের অধিকাংশই গার্মেন্ট শ্রমিক। রোববার কারখানা খোলা। কাজে যোগ না দিলে বেতন হবে না, চাকরিও থাকবে না, এরকম কথা কে বা কারা ছড়িয়ে দেয়ায় তাদের এই ঢাকা ফেরার প্রায় অসম্ভব ও প্রাণান্তকর প্রয়াস। লঞ্চ-স্টিমার বন্ধ, ট্রেন বন্ধ, গণপরিবহন বন্ধ। এমতাবস্থায়, যে যাতে সম্ভব চড়ে কিংবা পায়ে হেঁটে ঢাকা আসার ঝুঁকি নিয়েছে। দেশ কী পরিস্থিতির মুখে, কারো অজানা নেই। মহামারী আকারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে লাগাতার ছুটি চলছে। এ সময় জরুরি কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া সব ক্ষেত্রেই বন্ধ চলছে। অন্যদিকে চলছে প্রাতিষ্ঠানিক ও হোম কোয়ারেন্টাইন, সন্দেভাজনদের বাড়ি ও এলাকা লকডাউন এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করার কর্মসূচি। যেখানে দু’জনের নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করা বাধ্যতামূলক, সেখানে হাজার হাজার লোকের সমাগম, মেলামেশা, চলাচল কীভাবে সম্ভব হতে পারে সেটা বিস্ময়কর। বলার অপেক্ষা রাখে না, লোভ বা লাভই এক্ষেত্রে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। গার্মেন্ট কারখানার মালিকরা অধিক লাভের আশায় এ দুর্যোগ ও ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে কারখানা খুলতে প্ররোচিত হয়েছে। অন্যদিকে গার্মেন্ট শ্রমিকরাও নিতান্ত লোভের বশবর্তী হয়ে বিপদ মাথায় নিয়ে কাজে ফিরতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
ছুটির কারণে শুধু গার্মেন্ট নয়, সব শিল্পকারখানাই বন্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। বন্দর বন্ধ। যোগাযোগ বন্ধ। প্রতিষ্ঠান মাত্রেই অচলাবস্থার শিকার। এই সঙ্গে সব শ্রমিকও কর্মহীন। দেশে শ্রমিক আছে ৬ কোটির ওপর। এর মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশ (১ কোটির কম) প্রতিষ্ঠানিক খাতে এবং ৮৫ শতাংশ (৫ কোটির বেশি) অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। গার্মেন্ট খাতে ৩০-৩৫ লাখ শ্রমিক কাজ করে। যদি তারা কাজে যোগ না দেয় এবং কারখানাগুলো বন্ধ থাকে তাহলে দেশের কী খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে? বিশেষ পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এর সার্বিক ক্ষতি অপূরণীয়। করোনা সংক্রমণ রুখতে এবং প্রাণ বাঁচাতে এই ছুটি, কোয়ারেন্টাইন, লকডাউন, শাটডাউন, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। গার্মেন্ট মালিকরা তাদের কারখানা খুলে, শ্রমিক ডেকে এই সংক্রমণ ও মৃত্যুর শঙ্কাকে বেতোয়াক্কা করেছে। ২৬ মার্চ থেকে ছুটি ঘোষণা করা হলে, তার পরের কয়েকদিন ঢাকা থেকে শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি, পেশার মানুষ গ্রামে চলে যায়। এক খবরে দেখা যায়, ১ কোটির ওপর মোবাইলফোন গ্রাহক শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে। এটা ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক একটা ব্যাপার। ঢাকা বা অন্যান্য শহর থেকে গ্রামে যাওয়াদের কারো মধ্যে যদি করোনাভাইরাসের উপস্থিতি থাকে তবে সংশ্লিষ্ট গ্রাম, এলাকা, উপজেলা ও জেলায় সর্বনাশ হয়ে যাবে। তখন সরকারের তরফে তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য বলা হয়। এ প্রসঙ্গে এও বলা দরকার, দু’তিন মাসের ব্যবধানে বিদেশ থেকে অন্তত ৬ লাখ লোক দেশে ফিরে আসে, যাদের অধিকাংশই তখন গ্রামে। এটাও একটা ভয়ের কারণ ছিল। তাদের কারো মধ্যে এই ভাইরাস থাকলে তা আশপাশের সবার মধ্যে সংক্রমিত হয়ে যেতে পারে। এজন্য এ বিদেশ ফেরতদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। অত্যন্ত দুঃখজনক যে, ঢাকাফেরত ও বিদেশফেরতদের স্বল্প সংখ্যাকেরই ঘরে আটকে রাখা যায়। এর ফল আশঙ্কাজনক হয়েছে। সব শেষ খবর হলো, দেশের অন্তত ১০ জেলায় করোনায় আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ জন। আর করোনা উপসর্গে মারা গেছে ৬০ জনের কম হবে না।
কারখানায় কাজে যোগদানের নামে বা অন্যান্য কারণে যারা মিছিল করে বা দল বেঁধে ঢাকায় প্রবেশ করেছে বা করবে তারা যে নিরাপদ বা তাদের কেউ যে করোনাভাইরাস বহন করছে না, তার নিশ্চয়তা আছে কি? নেই। ভাইরাস বহনকারী কেউ থেকে থাকলে এবং তার সংস্পর্শে যারাই ইতোমধ্যে এসেছে বা ভবিষ্যতে আসবে তারা অনিবার্যভাবে আক্রান্ত হবে। ঢাকা শহরে টানা এগারো দিন ঘরে থাকা ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মেনে চলতে নাগরিকদের অনেক অসুবিধা, অনেক কষ্ট ও যাতনা ভোগ করতে হয়েছে। তারা এসব সহ্য করেছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা পাওয়ার জন্য। ঢাকায় ফিরে আসা লোকদের কারণে যদি তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, তাদের মাধ্যমে তারা সংক্রমণের শিকার হয়, তাহলে এতদিন ঘরবন্দি থাকাতে, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মেনে চলা ইত্যাদির কী মানে হলো? করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সকল মহল থেকে বারবার বলা হচ্ছে: স্টে হোম, স্টে হোম, স্টে হোম। এটাই এই ভাইরাস থেকে দূরে থাকার একমাত্র উপায়। গার্মেন্ট মালিকারা তা জানে, গার্মেন্ট শ্রমিকরা জানে, অন্যরাও জানে। তাহলে এই ব্যতিক্রমটি ঘটলো কেন? এরপর কোনো কিছু হলে তার দায় কে নেবে। দায় মালিক-শ্রমিক উভয়েরই নিতে হবে। সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও দায় এড়াতে পারবে না। বাণিজ্যমন্ত্রীর ‘পোশাক কারখানা চলতে বাধা নেই’, এমন মন্তব্য এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতরের অভয় পাওয়ার পর গার্মেন্ট মালিকরা কারখানা চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। এটা যে বড় রকমের বিচ্যুতি, ভ্রান্তি ও অপরিণামদর্শিতা তাতে সন্দেহ নেই। এনিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিজিএমইএর সভাপতি আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখতে মালিকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। আমরা আশা করি, এ অনুরোধ রক্ষিত হবে। একই সঙ্গে গ্রাম থেকে ফিরে আসাদের ব্যাপারে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা ও পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন