‘ধান দিয়ে কী হইব, মানুষের জান যদি না থাকে’ (সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ)। করোনাভাইরাস ঠেকাতে অঘোষিত লকডাউনে সবকিছু যখন বন্ধ; তখন হঠাৎ করে গার্মেন্টস খুলে দেয়া এবং লাখ লাখ কর্মীর গ্রাম থেকে ট্রাকে করে ঢাকায় আসা আবার ফিরে যাওয়ার দৃশ্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু উপন্যাসের এই উক্তি স্মরণ করিয়ে দেয়। তৈরি পোশাক শিল্প বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স এনে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করছে। কিন্তু যে মানুষের জন্য ওই রেমিট্যান্স সেই মানুষ যদি করোনায় শেষ হয়ে যায় তাহলে টাকা দিয়ে কি হবে? বিশেষজ্ঞরা প্রতিদিন প্রচার করছেন করোনাভাইরাস কিভাবে মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ায়। তারা সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টির পরামর্শ দিলেও অনেকেই মানছেন না। এ অবস্থায় গার্মেন্টসের লাখ লাখ কর্মী গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে আবার গ্রামে ফিরে গিয়ে মানুষের সঙ্গে মিশে গেছেন। এ অবস্থায় প্রয়োজন কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব কার্যকর। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, এখনই কঠোর না হলে পরিস্থিতি চরম অবনতি ঘটতে পারে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সভা করে গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রী বলেছেন, আগামী ৩০ দিন খুবই ভয়াবহ। কমপক্ষে ১৫ দিন কোনোভাবেই ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। প্রশ্ন হচ্ছে ৩০ দিন ভয়ের হলে ৩০ দিন লকডাউন নয় কেন? আর এটা কার্যকর করতে হবে কঠোরভাবে।
শুধু ছুটি নয়, পুরোপুরি লকডাউন কার্যকর প্রয়োজন। বিশ্বের ১৮টি অনুন্নত দেশ লকডাউন কঠোরভাবে কার্যকর করে সফলতা পেয়েছে। আমরাও যেতে পারি সে পথে।
পৃথিবীর মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেনসহ অর্থনৈতিকভাবে পরাক্রমশালী দেশগুলো যখন করোনার ছোঁবলে ক্ষতবিক্ষত; তখন ১৮টি দেশে এখনো করোনা প্রবেশ করতে পারেনি। দেশগুলো হচ্ছে তুর্কমেনিস্তান, ইয়েমেন, কমোরোস, উত্তর কোরিয়া, কিরিবাতি, লেসোথো, মার্শাল আইল্যান্ডস, মাইক্রোনেশিয়া, নাউরু, পালাউ, সামোয়া, সাও তোমে অ্যান্ড প্রিনসিপ, সলোমোন আইল্যান্ডস, দক্ষিণ সুদান, তাজিকিস্তান, টোঙ্গা, টুভালু ও ভানুয়াতু। চীনের করোনার গন্ধ পেয়েই এসব দেশে পুরোপুরি লকডাউন করে দেয়া হয়। অফিস আদালত বন্ধ, জরুরি অবস্থা জারি, রাস্তায় অযাচিত চলাচল নিষিদ্ধ, ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তা কঠোরভাবে পালন করা হয়। নাগরিকদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করে গরিব দেশগুলো করোনামুক্ত। বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে জ্যামিতিক হারে করোনা বিস্তার ঘটছে। চীন, তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর করোনায় কাবু ছিল। কিন্তু ওই দেশগুলো লকডাউনে কঠোর কোয়ারেন্টাইন পালন-সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে সফলতা পাচ্ছে। সে পথেই হাঁটতে শুরু করেছে এখনো করোনা আক্রান্ত দেশগুলো। বাংলাদেশ এখনো সে পথে হাঁটছে না কেন?
বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তের তালিকা বাড়ছে। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনলাইন ব্রিফিংয়ে জানানো হয় রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি ১৫টি জেলায় করোনা ছড়িয়েছে। বাংলাদেশে প্রথম দিকে ধীরে ধীরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও গত দুই-তিনদিন ধরে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। এ অবস্থায় গতকাল সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে জরুরি সভা করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সভায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘শক্ত অবস্থান’ নেয়ার পরামর্শ দেন। বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আহমেদুল কবীর বলেন, ‘এখনই পুরো দেশে লকডাউন করা জরুরি। পুরো দেশ কঠোর লকডাউন না করা হলে আগামী ১০ দিনে করোনা ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে’। বিশেষজ্ঞদের এমন মন্তব্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেছেন, ‘কোথায় কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় আমি জানি না’। প্রশ্ন হচ্ছে- এখন কি দায়িত্বশীলদের অসহায়ত্ব প্রকাশের সুযোগ রয়েছে? করোনা থেকে রক্ষা পেতে এখন প্রয়োজন কঠোরভাবে লকডাইন কার্যকর করা।
আমেরিকা-ইউরোপের নাগরিকেরা পরিশ্রমী। তারা সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় ক্লাব-পাঠাগার, হোটেল বারে ফুর্তি খেয়েদেয়ে বাসায় ফেরেন। লকডাউনের কারণে তারা দীর্ঘদিন থেকে ঘরে রান্না করে খাচ্ছেন। বাংলাদেশের মানুষের লকডাউনে ঘরে থাকতে অসুবিধা কোথায়? আর অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের যে অবস্থা তাতে কেউ না খেয়ে থাকবেন এমন পরিস্থিতি নেই। তবে সব সময় মাছ-গোশতের বদলে ডাল-ভাত খেতে হতে পারে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকার সহায়তাও করছে। এখন সামাজিক বিচ্ছিন্নতা কঠোরভাবে পালন ছাড়া করোনার হাত থেকে বাঁচা সম্ভব নয়।
চীনের উহানে আক্রমণের পর বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো করোনাকে পাত্তা দেয়নি। তার খেসারত এখন দিচ্ছে। কিন্তু আমরা! বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। প্রথম মৃত্যু ঘটে ১৮ মার্চ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয় ১৮ মার্চ থেকে। অফিস আদালত প্রথম সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল। অতঃপর ৫ এপ্রিল থেকে ১১ এপ্রিল ছুটি হয় বর্ধিত। তারও পর সেটা ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। পর্যায়ক্রমে ছুটি কোনোভাবেই সঙ্কটে সমাধান দেবে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন প্রয়োজন টানা কমপক্ষে ৩০ দিন লকডাউন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা করোনা ঠেকাতে পুরোপুরি লকডাউনের অনুরোধ করছেন। অথচ চলছে ছুটি। ছুটি আর লকডাউন ভাবার্থ এক নয়। ছুটিতে অফিস আদালত বন্ধ থাকলেও নাগরিকের চলাফেরা সীমিত হলেও বন্ধ থাকে না। কিন্তু লকডাউন হলো সবকিছু লকড। ঘোষিত সময় থেকে জরুরি পরিষেবা ছাড়া অফিস, দোকানপাট এবং গণপরিবহন বন্ধ। অনেকটা জরুরি অবস্থা জারির মতোই। কেউ এই নির্দেশিকা মেনে না চললে, তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন চাল-ডাল, সবজি, মাছ-মাংস কেনা, ওষুধ কেনা, জরুরি পরিস্থিতিতে চিকিৎসক বা হাসপাতালে যাওয়া গেলেও লকডাউনের মধ্যে রাস্তায় বেরিয়ে পুলিশের সামনে পড়লে যদি উপযুক্ত কারণ না দেখাতে পারে শাস্তি অনিবার্য। ভারত এখন লকডাউন পথে হাঁটছে। চীনে করোনার প্রাদুর্ভাবের খবর ছড়িয়ে পড়ার পথম দিকেই অনুন্নত, ছোট ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ১৮ দেশ লকডাউন কঠোরভাবে পালন করে পুরো বিশ্বের ‘করোনা ঠেকানো’ রোল মডেল হয়েছে। করোনার বিস্তার রোধে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা দেশগুলো পারলে আমরা পারব না কেন? আর মানুষ ঘরে থাকার চেষ্টা করলে পারবে না কেন? মনীষীরা বলেছেন, ‘মানুষ অভ্যাসের দাস নয়, অভ্যাসই মানুষের দাস’। কবি কালীপ্রসন্ন ঘোষ লিখেছেন ‘পারিব না এ-কথাটি বলিও না আর/ কেন পারিবে না তাহা ভাবো একবার; পাঁচজনে পারে যাহা, তুমিও পারিবে তাহা, পারো কি না পারো করো যতন আবার একবার না- পারিলে দেখো শতবার’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন