করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারীর আতঙ্ক সবাইকে তাড়া করছে। কার মাঝে নেই ঢর-ভয় শঙ্কা? সাধারণ মানুষের পাশাপাশি করোনা সংক্রমণ নিয়ে ডাক্তার-নার্সরাও রোগীর চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে আতঙ্কে আছেন। অনেকেই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। পিছু হটেছেন নিজেদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে গিয়ে
আর তেমনি একটি করোনাকালের চরমতম সময়ে জীবন বাঁচানোর, সাজানোর যুদ্ধে মাঠে তৎপর একজন ব্যতিক্রম ডাক্তার। চট্টগ্রামের ডা. জাহানারা শিখা। এরই মধ্যে তিনি রীতিমো যুদ্ধে লড়ে মারাত্মক জটিল অবস্থায় থাকা একজন প্রসূতির মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে তার কোলে তুলে দিলেন সুস্থ শিশুসন্তান। চট্টগ্রামবাসী যারা ইতোমধ্যে তার সম্পর্কে জেনে গেছেন তারা সাবাশ দিচ্ছেন।
আর বলছেন, আজ এই দুঃসময় পাড়ি দিতে তোমায় খুঁজছে বাংলাদেশ...।
মানবিক ডাক্তার জাহানারা শিখার পেশাগত কর্মকাণ্ডের অনেক ঘটনা গল্পের মতোই।
তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে প্রসূতি ও ধাত্রীবিদ্যায় নেন উচ্চতর ডিগ্রি। ২৫তম বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের এই চিকিৎসক কর্মরত আছেন চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালে।
করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে জেনারেল হাসপাতাল। তাই আপাতত সেখানে প্রসূতিরা চিকিৎসা সেবা নিতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে অতিসম্প্রতি জটিল অবস্থায় ভর্তি হতে আসেন এক গর্ভবতী। তাকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে ডা. জাহানারা শিখা করোনার দুর্যোগকালে অনন্য উদাহরণ স্থাপন করলেন।
নিজের ফেইসবুক স্ট্যাটাসে ডা. জাহানারা লিখেছেন- ‘বেসরকারি হাসপাতালে একটা ডেলিভারি কেস এটেন্ড করি। রোগীর শ্বাসকষ্ট ও কাশি ছিল খুব। শ্বাসকষ্টের অজুহাত দিয়ে সেখানকার ডিউটি ডক্টর ফোনে প্রথমে মৃদুভাবে আমাকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টাই করেন। যাতে রোগীকে ভর্তি না দিতে হয়।
ভর্তি নেবে না মনে করে রোগীর অভিভাবক মরিয়া হয়ে আমাকে ফোন করেন। হিস্ট্রি শুনে বুঝলাম, অ্যাজমার একিউট অ্যাক্সারবেশন হতে পারে। তাছাড়া রোগীর জ্বর নেই। বললাম-ভর্তি দাও। লেবার ডিউরেশন কারটেল করা আর শ্বাসকষ্ট নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করলাম ফোনে।
এরপর আমি যখন হাসপাতালে পৌঁছালাম তখন লেবার প্রগ্রেস করে গেছে। কিন্তু রোগীর শ্বাসকষ্ট তখন চরমে। ডেলিভারীর পর শুরু হলো প্রচণ্ড ব্লিডিং। তার উপর এমন ভয়ঙ্কর শ্বাসকষ্ট দেখে এক পর্যায়ে ঘাবড়ে গেলাম কিছুটা। সিস্টার-ডক্টর পুরো বাহিনীকে পাশে রেখে একটার পর একটা ম্যানেজমেন্ট দিয়ে যাচ্ছি। আর প্র্াণপণে আল্লাহ্কে ডাকছি। মাস্কের ভেতর দিয়েই রোগী যখন একেকটা কাশি দিচ্ছিলেন তখন আমার সহকারীরা কয়েক হাত দূরে সরে যাচ্ছেন। আবার ভয়ে ভয়ে কাছে এগিয়ে আসছেন’।
‘টেনশনে নিজের মাস্ক যে কখন নাক থেকে সরে গেছে লক্ষ্যই করিনি। লাংস পরীক্ষা করতে যখন রোগীর কাছে গেলাম, দেখি শ্বাসকষ্টে নীল হয়ে যাওয়া আমার রোগী ওই অবস্থাতেও আমাকে ইশারা করছে- আমি যেন নাকের উপরে আমার মাস্কটা তুলে লাগিয়ে নিই’।
‘ততক্ষণে আমার পাশে থাকা সহকর্মী ইমোশনাল, ডাক্তার-নার্সসহ আমার নিজেরও চোখ ভিজে গেছে’।
‘উল্লেখ্য আমার রোগীটা এখন সুস্থ আছেন। আলহামদুলিল্লাহ। ডেলিভারির পরপরই শ্বাসকষ্ট কমে যায় তার। হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার দুদিন পর খবর নিই। ভালো আছেন আল্লাহ্র রহমতে’।
মানবিক ডাক্তার জাহানারা আরও লিখেন- ‘ইদানিং রুটিন চেম্বার বন্ধ থাকায় রোগীদের অসংখ্য ফোন কল এটেন্ড করতে হয়। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠি। এ রকম একটা ফোন ধরে একটু রূঢ় স্বরেই বলে ফেলি- ‘বলেন কী সমস্যা?’
নাহ। সমস্যার কথা উনি বলেননি। বললেন,‘ম্যাডাম আপনি ভাল আছেন তো? আপনার খবর নিতেই ফোন করেছি। আমার ছেলেটার এখন তিন বছর। আপনার হাতে দিয়ে জন্ম। ওকে আপনার কথা বলি। আপনার জন্য সবসময় দোয়া করি। নিরাপদে থাকবেন ম্যাম’।
‘মনটা আমার ভীষণ রকম ভিজে গেল ভালোবাসায়’।
‘চট্টগ্রাম বন্ধুরা চমৎকার দুইসেট করে পিপিই উপহার দিল ব্যাচের সকল ডাক্তারকে। একেবারে নিজেরা ফান্ড তৈরি করে। নিজেদের উদ্যোগে। দায়িত্ববোধ, সহমর্মিতা আর ভালোবাসা যেখানে হাত ধরে চলে সেখানে কোন দুর্যোগই কী পারে মানুষকে টলাতে?’
এই প্রশ্নটি রাখলেন ডা. জাহানারা শিখা...।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন