'জেলা চট্টগ্রাম রে বারো আউলিয়ার স্থান, এই দেশেতে জন্ম কত আউলিয়া মোস্তান রে' জনপ্রিয় সব শিল্পীর গাওয়া এ গান মানুষের মুখে মুখে। বারো আউলিয়ার শহর চাটগাঁ এখন কেমন আছে।
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মহামারীতেও ভিন্ন এক আবহ চট্টগ্রামে। প্রাণ খুলে অকাতরে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে ঐতিহ্য তার নজির মিলছে সর্বত্র। অতিথি পরায়ন এখানকার বাসিন্দারা প্রতিবেশীদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে চলছেন। দুর্যোগে নিজেদের সুরক্ষায় মহান আল্লাহর দরবারে আহাজারি আকুল ফরিয়াদ এখন প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে। সংক্রমণ ঠেকাতে মসজিদে নামাজ আদায় সীমিত করা হয়েছে । এ অঞ্চলের আলেম উলামাদের মধ্যে নানা বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও তারা সকলেই সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন। মসজিদে না গিয়ে বাসায় নামাজ আদায় করতে আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন তারা। বারো আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামের মানুষ এমনিতেই ধর্মপ্রাণ। মহামারী দুর্যোগে মানুষের মধ্যে ইবাদত বন্দেগির প্রবণতা আরো অনেক বেড়েছে। অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরাও দুর্যোগ থেকে মুক্তি পেতে প্রার্থনা করছেন। সবমিলিয়ে মানুষের মধ্যে সহনশীলতা, অন্যের প্রতি সম্মান সহযোগিতার প্রবণতাও দেখা যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অঞ্চলের মানুষের যে অনন্য বৈশিষ্ট্য তা এ কঠিন সময়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বাবুল ইসলাম বা ইসলামের প্রবেশদ্বার চাটগাঁ। আরব বণিকদের সাথে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারক পীর দরবেশের আগমন ঘটে। তাদের মাধ্যমেই এই অঞ্চলের মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আসে। ইতিহাস থেকে জানা যায় বদর আউলিয়া (১৪ শতক) একজন দরবেশ। তিনি অপর এগারোজন দরবেশের সঙ্গে চট্টগ্রাম এসেছিলেন। এ দরবেশগণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে সমাহিত আছেন। বারোজন দরবেশের মধ্যে বদর আউলিয়াকেই প্রধান হিসেবে সম্মান দেখানো হয়। বদর আউলিয়া চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার করেন। এ কারণে লোকপ্রিয়ভাবে চট্টগ্রাম ‘বারো আউলিয়ার দেশ’ (বারো দরবেশের দেশ) বলে পরিচিতি লাভ করে। ঐতিহ্য অনুসারে, চট্টগ্রাম জেলার মানব বসতির সাথে বদর আউলিয়ার নাম জড়িত। চট্টগ্রামের অধিবাসীরা তাঁকে তাদের অভিভাবক হিসেবে গভীর শ্রদ্ধা করে।
বৌদ্ধ, হিন্দু ও চৈনিকগণ বদর আউলিয়াকে পরমেশ্বর অথবা আত্মার অধস্তন হিসেবে ভক্তি করে। অন্যদিকে মুসলিমগণ তাঁকে আউলিয়া বা দরবেশ হিসেবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। পূর্ব বাংলার মাঝিরা অন্য পাঁচজন দরবেশের (যারা পাঁচ পীর নামে পরিচিত) সাথে বদর আউলিয়ার নাম উচ্চারণ করে থাকে। সমুদ্রউপকূল ধরে দক্ষিণে সুদূর মালয় উপদ্বীপ ছাড়িয়েও সমুদ্রগামীদের কাছে তিনি নিত্যদিনের রক্ষক হিসেবে বিবেচিত। মিয়ানমারের টেনাসেরিমের জনগণ তাঁকে মাদরা বলে ডাকত। আকিয়াবের অধিবাসীদের কাছে তিনি বুদ্ধ আউলিয়া বা বুদ্ধ সাহেব হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রামের অধিবাসীরা তাঁকে বিভিন্ন নামে ডাকে যেমন, বদর আলম, বদর আউলিয়া, বদর পীর বা পীর বদর ও বদর শাহ। চট্টগ্রামের পুরাতন দুর্গ এলাকা অন্দরকিলার অন্তর্গত বর্তমানের বখশীর হাটের নিকটবর্তী বদরপট্টি বা বদরপটি নামে পরিচিত স্থানে বদর আউলিয়ার মাযার অবস্থিত।
এ অঞ্চলের লোক সাংস্কৃতির মধ্যেও আছে পীর আউলিয়ার নানা কাহিনী। মরমী শিল্পী আবদুল গফুর হালি, মলয় দস্তিদার, শেফালী ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব ছাড়াও অনেক শিল্পীর গাওয়া গানে এসেছে ইসলাম প্রচারক পীর দরবেশের নাম।
হযরত বায়েজিদ বোস্তামি, হযরত মিসকিন শাহ, হযরত টাকশাহ, হযরত শাহ ওলি খাঁসহ অসংখ্য পীর আউলিয়ার ইসলাম প্রচারের ইতিহাস রয়েছে । তরবারি নয়, এসব পীর আউলিয়া, সুফি দরবেশের প্রচেষ্টা আর তাদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার গুণে এ অঞ্চলে ইসলামের প্রসার ঘটে। এ কারণেই এখানকার মানুষ শান্তিপ্রিয় এবং সহনশীল। তাই প্রতিটি দুর্যোগে দুঃসময়ে এ জনপদের মানুষ মানবতার পক্ষেই দাঁড়ানোর নজির সৃষ্টি করেছে। করোনা দুর্যোগেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
শুরু থেকেই ধনাঢ্য ব্যবসায়ী দানশীল ব্যক্তিরা অসহায় মানুষের পাশে । আলেম উলেমা , পীর মাশায়েখগণ্ও অসহায় মানুষের সাহায্য করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন দরবার এবং খানকা থেকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে । মহামারী থেকে মানুষের জীবন রক্ষায় মহান আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতে হাজার হাজার আলেম মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক পবিত্র কোরআন শরীফ খতম, তিলাওয়াত, দোয়া দরূদ পাঠ করে চলেছেন।
ঘরে বাড়িতে সারারাত নফল নামাজ কোরআন শরীফ তিলাওয়াত জিকির আজগার দোয়া দরূদ পাঠ করেন ধর্মপ্রাণ মানুষ । নারী পুরুষের সঙ্গে শিশু কিশোররা ও নামাজ আদায় করে । অনেকেই নফল রোজা রাখছেন। যারা ধর্মীয় বিধি বিধান অনুসরণ করার ক্ষেত্রে উদাসীন ছিলেন তারাও সুপথে আসছেন। ইসলামের চর্চা বেড়েছে সেই সাথে সুদৃঢ় হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। সন্তানরা মা বাবার বাধ্য হচ্ছে। পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি মনোযোগ বাড়ছে। ঘরবন্দি জীবন ইসলামের সুমহান শিক্ষা ও সাংস্কৃতি চর্চার অনুপম সুযোগ এনে দিয়েছে। যা করোনা পরবর্তী সময়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এই অঞ্চলের মানুষ ঐতিহাসিক ভাবে সাহসী। সাগর দরিয়ায় পাড়ের মানুষ নানা দুর্যোগ মোকাবিলায় অসীম সাহসী ভূমিকা পালন করে আসছে।
'ও ভাই আরা চাটগাইয়া নওজোয়ান, দইজ্জার কুলত বসদ গড়ি
শিনা-দি ঠেহাই ঝড় তোয়ান' এমন সংস্কৃতি ধারণ করে বেঁচে থাকা এ জনপদের মানুষ এমন কঠিন সময়েও বুকে সাহস রাখছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন