শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মিয়ানমারে ইসলামবিরোধী বক্তব্য না দেয়ার নির্দেশ

প্রকাশের সময় : ১৭ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মিয়ানমারের অং সান সুচির দল এনএলডি ক্ষমতায় আসার পর গত কয়েক মাসে দেশটিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। দেশটির বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক সংগঠন ‘মা বা থা’ তার মুসলমানবিদ্বেষী কার্যক্রম জোরেশোরে চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি সংগঠনটির নেতৃত্বে দুটি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সংগঠনটি রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। রোহিঙ্গারা মুসলমান বলে তার রোষের মুখে পড়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সংগঠনটি বাঙালিবিরোধী আন্দোলন বলছে। সংগঠনটির এসব বিদ্বেষ ও হিংসাত্মক কর্মকা- দমন করতে না পারায় দেশটির মানবাধিকার সংগঠনগুলো সরকারের কঠোর সমালোচনা শুরু করেছে। তারা অভিযোগ তুলেছে, সরকার মানবিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অং সান সুচির সরকার নড়েচড়ে বসেছে। প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের ধর্মমন্ত্রী উগ্রবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা আর ইসলামবিরোধী ‘হেট স্পীচ’ বা ঘৃণ্য বক্তব্য না দেয়। অং সান সুচিও গত মাসে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি নিষিদ্ধ করার দাবী জানিয়েছেন। তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যের মুসলিম গোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করতে। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তার এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে এবং রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করে ঘৃণামূলক প্রচারণা শুরু করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ধর্মমন্ত্রী তাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
মিয়ানমারে যারা রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত তারা মূলত সেখানে আদিকাল থেকে বসবাস করে আসছে। তারা সে দেশের অন্যতম আদি বাসিন্দা। বৌদ্ধদের সাথে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মাধ্যমেই শত বছর ধরে তারা বসবাস করে আসছে। যে সময়টিতে দেশটি সামরিক শাসকদের কবলে চলে যায়, তখন থেকেই এই সম্প্রীতি বিনষ্টের সূচনা হয়। বলা যায়, সামরিক শাসকের মদদে উগ্রবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বেশ কয়েকটি মুসলিমবিদ্বেষী দল গড়ে উঠে। দলগুলো মুসলমানদের বিনাশ করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। বড় বড় জনসভার আয়োজন করে মুসলমানদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়নের আহ্বান জানাতে শুরু করে। ফলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর নেমে আসে অমানুষিক নিপীড়ন ও নির্যাতন। বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সামরিক সরকারের বাহিনী মিলে রোহিঙ্গাদের উপর একের পর এক হামলা, হত্যা ও উচ্ছেদ কার্যক্রম চালাতে থাকে। তাদের হত্যাকা- থেকে শিশুরা পর্যন্ত রেহাই পায়নি। প্রাণভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান দেশ ছেড়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়। শত নির্যাতন সত্ত্বেও যারা থেকে যায়, তারা নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়ে। তাদের মৌলিক অধিকার হরণ থেকে শুরু করে নাগরিকত্ব থেকেও বঞ্চিত করা হয়। সর্বশেষ আদমশুমারি জরিপে রোহিঙ্গাদের কোনো ঠাঁই হয়নি। তাদের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের উপর সামরিক সরকার ও উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হামলা ও নির্মম হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো কোনো ধরনের টুঁ শব্দ করেনি। এখানে যে মানবতার চরম লঙ্ঘন হচ্ছে, এ ব্যাপারে তারা নিশ্চুপ থেকেছে। অথচ অন্য কোনো দেশে সামান্য ঘটনায়ও দেশগুলো উদ্বিগ্ন হয়ে এন্তার বক্তব্য-বিবৃতি দিতে থাকে। এমনকি ব্যবস্থা গ্রহণেরও কথা বলে। তাদের এই একচোখা আচরণ থেকে প্রতীয়মান হয়, মিয়ানমারের মুসলমানরা যেন মানুষ নয়। প্রভাবশালী দেশগুলোর এই নীরব আচরণে মিয়ানমারের সামরিক সরকার ও মৌলবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মুসলমান নিধনে আরও উৎসাহী হয়ে উঠে। নিরীহ রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে অসহায় এক জাতিতে পরিণত হয়। দীর্ঘ সামরিক শাসনের অবসান শেষে নির্বাচনের মাধ্যমে অং সান সুচির নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সকলেই আশা করেছিল, নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী ও গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলে অভিহিত সুচি রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক হবেন এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। অথচ দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের উপর উগ্রবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা আরও খড়গহস্ত হয়েছে। তাদের দেশ থেকে বিতাড়নে সব ধরনের নিপীড়নমূলক কর্মকা- জোরদার করেছে। এ ব্যাপারে সুচি তেমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। অবশেষে দেশটির মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সোচ্চার ভূমিকার কারণে সুচি রোহিঙ্গাদের প্রতি সুদৃষ্টি দেয়া শুরু করেছেন বলেই মনে হয়। এই ধারাবাহিকতায় ধর্মমন্ত্রী মুসলিমবিদ্বেষী কোনো বক্তব্য না দিতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। সরকার প্রথমবারের মতো উগ্র ভিক্ষুদের দলগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন দল এনএলডি আনুষ্ঠানিকভাবে দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এমনকি দলগুলোর নেটওয়ার্ক নিষিদ্ধ করার কথাও ভাবছে।
দেরিতে হলেও মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশার বিষয়টি উপলব্ধি করেছে। রোহিঙ্গারা যে সে দেশেরই নাগরিক এবং সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে, সরকারের এ চিন্তা-ভাবনা ও উদ্যোগ গ্রহণকে আমরা স্বাগত জানাই। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য অং সান সুচির দাবীর প্রতিও একাত্মতা প্রকাশ করছি। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের অভ্যন্তরে জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব বিরাজমান রেখে কোনো দেশই ভাল থাকতে পারে না। রাষ্ট্রের চোখে যদি সকল নাগরিক সমান না হয়, সে রাষ্ট্র ব্যর্থ হতে বাধ্য। মিয়ানমারের সরকার বিষয়টি উপলব্ধি করেই রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিদ্বেষ ও ঘৃণামূলক বক্তব্য না দেয়ার নির্দেশ ও অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। আমরা আশা করব, মিয়ানমার সরকার ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সে দেশের সকল নাগরিকের প্রতি সমান আচরণ করবে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন