বাঙালি সংস্কৃতির বড় উৎসব পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ উৎযাপনের জন্য প্রতিবছরই নানা আয়োজন থাকে সারাদেশে। নতুন নতুন পোষাক, পান্তা-ইলিশ, হরেক রকমের মুড়ি-মুড়কি, গ্রামে-গঞ্জে বৈশাখী মেলাসহ আরও কত কী। বর্ণিল এই উৎসব উদযাপনের জন্য অপেক্ষায় থাকেন সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালিরা। তবে এবার এই উৎসবে হানা দিয়েছে করোনাভাইরাস। প্রাণঘাতি এই ভাইরাসের প্রকোপে স্থবির হয়ে পড়েছে গোটা বিশ্ব। বাংলাদেশেও প্রতিদিনই বাড়ছে সংক্রমিতের সংখ্যা। সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে সাধারণ ছুটি, এলাকায় এলাকায় চলছে লকডাউন। বাতিল করা হয়েছে পহেলা বৈশাখের সকল অনুষ্ঠান। যার প্রভাব পড়েছে উৎসবটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ব্যবসা-বাণিজ্যে। সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছে পহেলা বৈশাখের উৎসব বাতিল হওয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হতে পারে ব্যবসা-বাণিজ্যে।
পহেলা বৈশাখের সাথে গত কয়েকবছর ধরেই নতুন পোষাক অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে জড়িয়ে গেছে। ছেলেদের শার্ট, টিশার্ট, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, মেয়েদের কামিজ, থ্রিপিস, বৈশাখের শাড়ি, শিশুদের জন্য সাদা-লালের সমন্বয়ে বাহরি পোষাক। ক্রেতারা মার্কেটে গিয়ে কিংবা অনলাইনে অর্ডার করেই এসব সংগ্রহ করে। দেশের ফ্যাশনহাউজগুলো থেকেই এই পোষাক সরবরাহ করা হয়। করোনার কারণে এখন এসব ফ্যাশনহাউজ পণ্য উৎপাদন করে তা বিক্রি করতে না পেরে পড়েছেন বিপাকে।
অন্যমেলার কর্মকর্তা সানাউল কবির কিরণ বলেন, ফ্যাশন ব্যবসার ইতিহাসে এমন পরিস্থিতি আর কখনও আসেনি। এর আগে হরতাল অবরোধ হয়েছে, অনেক রাজনৈতিক অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়েছে দেশ। কিন্তু দিনের বেলায় মার্কেট খুলতে না পারলে রাতে চলেছে। অথবা রাতে বন্ধ ছিল দিনে চলেছে। একটানা এতদিন এভাবে কখনও ব্যবসা বন্ধ থাকেনি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উৎসবটি স্থগিত হওয়াতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। নারায়ণগঞ্জের তাঁতিপল্লিতে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখের আগে কারিগরদের দম ফেলার সময় হতো না। এবার তাদের হাতে কোন কাজ নেই। একের পর এক অর্ডার বাতিল হওয়ায় মহাজনরাও বিপাকে পড়েছেন।
ফ্যাশন হাউজ শৈলীর স্বত্বাধিকারী তাহমীনা শৈলী বুঝতে পারছেন না তিনি এবং তার মতো মাঝারি উদ্যোক্তারা কবে নাগাদ এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন। এবারের লোকসান সারা বছরব্যাপী বয়ে বেড়াতে হবে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পহেলা বৈশাখ ও ঈদ এই দুটি উৎসবেই পোষাকের বেচাকেনা জমে ওঠে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা এই দুটি উৎসবে টার্গেট করেই পরিকল্পনা সাজান। কিন্তু এবার করোনাভাইরাসের কারণে ইতোমধ্যেই পহেলা বৈশাখের সবকিছু স্থগিত হয়ে গেছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে ঈদের ক্ষেত্রে কোন আশার আলো দেখছেন না তারা। ফ্যাশন এন্টারপ্রেনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মো. শাহীন আহম্মেদ জানান, করোনার কারণে মার্চের শুরু থেকেই বেচাকেনা কম। তারপর শুরু হয় সাধারণ ছুটি, আবার বৈশাখের অনুষ্ঠান স্থগিত হওয়াতে পোষাকশিল্পে ৪-৫ কোটি টাকার ক্ষতি হবে। আড়ংয়ের কর্মকর্তা আশরাফুল আলম বলেন, করোনার কারণে বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে এই ক্ষতি হয়তো দু-এক বছরে পুষিয়ে নেয়া যাবে। তবে অবস্থা দীর্ঘমেয়াদি হলে সামনে কঠিন সময় আসবে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সূত্রে জানা গেছে, বৈশাখের বাজারে দেশীয় বাঁশ, বেত, কাঠের তৈরি জিনিস, মাটির তৈজসপত্র, খেলনা, মুড়ি-মুরকি, নাড়ু বিকিকিনি হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলেন, সকলে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে অনেক প্রস্তুতি ছিল। সেটা চলে গেল কিন্তু সামনে রমজান, ঈদ আছে। যারা ছোট উদ্যোক্ত আছে তাদের একটা বড় ধাক্কা। কেউ কেউ পহেলা বৈশাখের জন্য পোডাকশন করে ফেলেছিল তারা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখিন হবে।
বেসিসের সাবেক সভাপতি মাহবুব জামান বলেন, শুধু পহেলা বৈশাখই নয়, এটা সার্বিকভাবে সকল ব্যবসাকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের টিকে থাকাটা খুব কঠিন হয়ে যাবে। তবে আশার কথা হচ্ছে যে, মানুষের কেনাকাটার নতুন একটা ট্রাডিশন শুরু হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন