বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পুলিশের এ প্রবণতা উদ্বেগজনক

প্রকাশের সময় : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গত মাসে ঢাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী পুলিশের হাতে নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা গণমাধ্যমে বেশ শোরগোল তুলেছিল। এ দু’টি ঘটনা ছাড়াও সে সময় পুলিশের হাতে নারীর শ্লীলতাহানির অভিযোগেও আদালতে মামলা দায়েরের সংবাদ ছাপা হয়েছে। এ সব ঘটনায় পুলিশের বিভাগীয় তদন্ত কমিটি হয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় কেউ কেউ সাময়িক বরখাস্তেরও সম্মুীন হয়েছে। ইতিমধ্যে ঢাকায় সাড়ম্বরে পালিত হয়েছে ‘পুলিশ সপ্তাহ-২০১৬’। পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশকে জনবান্ধব হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও পুলিশকে আরো পেশাদার এবং আইনানুগ হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। এতদসত্ত্বেও একশ্রেণীর পুলিশের অপরাধপ্রবণতা হ্রাস পায়নি। গত ১ ফেব্রুয়ারী ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) তার প্রতিষ্ঠার ৪১তম বর্ষপূর্তি পালন করেছে। পুলিশকে একটি জনবান্ধব বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে পুলিশের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান, পুলিশ সপ্তাহ উদযাপন এবং একই সময়ে ডিএমপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে পুলিশ বাহিনীর অপরাধপ্রবণ সদস্যরা কি সংযত হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। গতকাল প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায়, রাজধানীতে আদাবর থানার এক উপ-পরিদর্শক (এসআই) রতন কুমারের বিরুদ্ধে নারী-শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেছেন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪-এর বিচারক বিচারপ্রার্থী ছাত্রীর জবানবন্দি গ্রহণ করে ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দিয়েছেন বলে জানা যায়। অন্যদিকে পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে অভিযুক্ত এসআইকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে সাময়িক বরখাস্ত করার কথা বলা হয়েছে। একই দিনে (গত রোববার) রাজশাহীতে এক অন্তঃসত্ত্বা নারী পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে গতকাল প্রকাশিত খবরে জানা যায়।
পুলিশের একশ্রেণীর সদস্যের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানাবিধ বেআইনী কর্মকা-ের অভিযোগ সবসময়ই ছিল এবং আছে। তবে গত কয়েক বছরে একশ্রেণীর পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নারীর শ্লীলতাহানি, ছিনতাই, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, মাদক-ইয়াবা চোরাচালান, মানবপাচারসহ নানাবিধ অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠতে দেখা গেছে। তবে এ সব অপরাধের দায়ে কাউকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার খবর খুব একটা জানা যায় না। গত বছরও বিভিন্ন অপরাধে ১০ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তি হলেও এদের মধ্যে অনেক গুরুতর ও ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য থাকলেও গুরুদ-ে দ-িত পুলিশ সদস্যের সংখ্যা খুবই কম। হত্যা, অপহরণসহ সমাজে ত্রাস সৃষ্টিকারী বেপরোয়া বেআইনী কর্মকা-ের বিভাগীয় শাস্তি হিসেবে তিরস্কার, প্রত্যাহার, বদলি, পদাবনমন বা সাময়িক বরখাস্তের মতো শাস্তিকে তেমন পরোয়া করছে না অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা। ধর্ষণ, অপহরণ, মাদক ব্যবসায়’র সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ার পরও বিভাগীয় শাস্তির বাইরে আদালতে মামলা ও শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার নজির বিরল। পুলিশের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব অন্য কোন সংস্থার উপর ছাড়তেও পুলিশ কর্তৃপক্ষ রাজি নয়।
সমাজে ক্রমবর্ধমান ও বহুমখী অপরাধপ্রবণতা মোকাবেলা করে নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই পুলিশের জন্য এখন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে পুলিশকে তার অভ্যন্তরীণ অপরাধপ্রবণতা মোকাবেলা করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। একশ্রেণীর পুলিশের ক্রমবর্ধমান অপরাধপ্রবণতা একদিকে যেমন পুরো পুলিশ বাহিনীকেই আস্থার সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন সরকারকেও মাঝে মধ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন করছে। সরকারের পক্ষ থেকে এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে পুলিশকে দুর্নীতিমুক্ত ও জনবান্ধব বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার তাগিদ দেয়া হলেও পুলিশ আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কারের কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।একইভাবে পুলিশে নিয়োগ, পদায়ন ও পদন্নোতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পক্ষপাত, স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ লেনদেন বন্ধেরও কার্যকর পদক্ষেপ প্রতীয়মান হচ্ছে না। প্রতি বছর অসংখ্য অপরাধী পুলিশকে বিভাগীয় শাস্তি দিয়েও পুলিশের অপরাধ কমিয়ে আনা যাচ্ছে না কেন, তা পুলিশ কর্তৃপক্ষকেই ভাবতে হবে। এ পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। আধুনিক বিশ্বে সাধারণ মানুষকে পুলিশের দ্বারস্থ হতেই হয়। স্বয়ং পুলিশই যদি সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? এমন পরিস্থিতিতে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়। এতে সামাজিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। অন্যদিকে পুলিশ সদস্যরাও প্রায়ই অপরাধীদের হাতে আক্রান্ত হচ্ছে। এ সব ঘটনায় পুলিশের ট্রেনিং, দক্ষতা ও আত্মরক্ষার যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ডিএমপির ৪১তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে নগরবাসীকে চকোলেট এবং বিশেষ শুভেচ্ছা বার্তা বিলি করা হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য রাখতে আইন মেনে চলতে এবং নাগরিক সমাজের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। নাগরিক সমাজের আস্থা অর্জনের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে পুলিশ বাহিনীর যে সব ঘাটতি রয়েছে তা যথার্থভাবে চিহ্নিত করা জরুরি। পুলিশকে সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের কাজে ব্যস্ত রেখে পুলিশের অপরাধ প্রবণতা রোধ অথবা জনবান্ধব করে তোলা সম্ভব নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন